ফারিহা হোসেন

  ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

সমাজ প্রতিষ্ঠায় চাই নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা

আমাদের সমাজব্যবস্থায় সনাতন মানসিকতার পরিবর্তে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। একই সঙ্গে চিন্তা চেতনা, ধ্যান-ধারণা, আচার-আচরণ, রীতি-নীতিতেও এসেছে পরির্বতন। বলতে গেলে সমাজের প্রতিটি স্তরে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের কল্যাণেই সম্ভব হয়েছে এই পরিবর্তন। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থক বাস্তবায়নের পর এখন তিনি স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছেন। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে, উন্নত জীবনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন সব উপকরণের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে চলতে না পারলে মানুষ হিসেবে আমরা পিছিয়ে পড়ব। কাজেই পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে আমরা যুক্ত হবো। তবে আমাদের শিক্ষা ও জীবনব্যবস্থার সঙ্গে মানবিকতা, সামাজিকতা, লৌকিকতা, মমত্ব বোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ এবং লালন করার মধ্য দিয়েই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মধ্যেই রয়েছে মানবজন্মের স্বার্থকতা। অর্থাৎ মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংযোগ হলে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এবং তখনই সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা সহায়ক হবে।

এসব বিষয় প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, আমরা যতটা বিজ্ঞান মনস্ক হচ্ছি, প্রযুক্তিনির্ভর হচ্ছি ততটাই মানবিকতা ও মনুষ্যত্ব বোধ লোপ পাচ্ছে, সমাজ থেকে সামাজিকতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, লৌকিকতা, বড়দের প্রতি সম্মানবোধ, ছোটদের প্রতি মায়া মমতা ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। এর বিশেষ কিছু কারণ রয়েছে। বর্তমান পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় মানুষের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তায় পরিবর্তন এসেছে। বাবা-মা ও অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তনের ফলে তাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে সাটিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষায় প্রলুব্ধ করছে তাদের সন্তানদের। এ অবস্থায় কোনো পরিবারে একটা সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হওয়ার পর বয়স বৃদ্ধির শুরু থেকেই নিজ পরিবার এবং সমাজের লোকদের কাছ থেকে নীতি, নৈতিকতা ও উপদেশ মূলক কথা শুনতে পায় না। বরং কার সন্তান কত শিক্ষিত হলো, পরীক্ষায় কি রেজাল্ট হলো, কে কোথায় পড়ে, পড়া শেষে কী করবে. কার ছেলে বিজ্ঞানী হলো, ইঞ্জিনিয়ার হলো ইত্যকার বিষয়ই মুখ্য হয়ে ওঠে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশীর মুখেও প্রতিনিয়ত শুনতে হয় এসব কথা। কিন্তু এই শিক্ষার সঙ্গে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার বিষয়ে কোনো কথা শুনতে পাওয়া যায় না। এটা দুঃখজনক। যদি আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে মানবিক এবং সুশিক্ষা দিয়ে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তাহলে সমাজ ও দেশ উপকৃত হবে। একই সঙ্গে মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

সন্তানদের পড়াশোনা এবং চাকরির ব্যাপারে শৈশব থেকে শুনতেই শুনতেই তাদের মস্তিষ্কে একটা ধারণা পুরোপুরিভাবে গেঁথে গিয়েছে যে, লেখাপড়ায় রেজাল্ট এবং তারপর চাকরিতে মাসিক আয় হলো আমাদের সব। কিছু আল্ট্রা লিজেন্ড ছেলে-মেয়ে আছে যারা শৈশবে স্বপ্ন দেখার প্রতি বিশ্বাসী থাকলেও পরে শুধু স্বপ্ন দেখার প্রতি সীমাবদ্ধ নয়, সেই স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রতি বিশ্বাসী হওয়ার। তারা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করে নিজের বর্তমান সময়কে বেশি অগ্রাধিকার দিলেও, পরে কিন্তু সেই আগের চিন্তায় ফিরে আসে। ভালোভাবে লেখাপড়া-ভালো একটা রেজাল্ট-ভালো একটা চাকরি-মাসিক আয় যথেষ্ট। কারণ তারা বুঝতে পারে, তাদের সঠিক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বড় হওয়া থেকে সমাজের মানুষ ভ্যালু দেবে ‘তোমার সেলারি কত?’ এই উক্তিতে। তাই তারা নিজেদের খুব ভালোভাবেই সংশোধন করে নেয়। ব্যাস এই হলো আমাদের সুন্দর ও সুখী জীবন। বাইরে শত খুশির উল্লাস করে গেলেও, শিক্ষার্থীরা নিজের খুশির, পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য তারা যা করতে বলেন, পড়তে বলেন, তাই তারা করে. তা তারা পড়ে। আমরা ভুলে যাই যে, আমাদের সন্তানদেরও ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দ, ভালোলাগা. মন্দলাগা থাকতে পারে। বাস্তবে নতুন প্রজন্মের সন্তানদের মনে হাজারো স্বপ্ন তাদের মনের মসনদে জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। কিন্তু তার কিইবা মূল্য আছে তাদের অভিভাকদের মধ্যে।

এই সমাজ আমাদের একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড় করায়। পরস্পর বন্ধু হয়েও শত্রুর মতো লড়াই করে যেতে বাধ্য করে। আমরা কেন বুঝি না এই জীবন আমাদের? সৃষ্টিকর্তা আমাদের এত সুন্দর একটি জীবন দান করেছেন, সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ না জানিয়ে আমরা তার সৃষ্টির অপব্যাবহার করছি। আমরা তো আমাদের প্রভুর দেওয়া এত সুন্দর আমানতের খেয়ানতই করে যাচ্ছি দিন কে দিন! জীবনে বাঁচতে শিখতে হবে, বাঁচতে পারাটাই হলো আমাদের মূল লক্ষ্য। তারপর চিন্তা আসে কি করে আর কীভাবে বাঁচা যায়। জীবন হলো খুব সুন্দর একটা ভ্রমণক্ষেত্রে। তাই মানুষ ভ্রমণ যাত্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।

আমাদের নিজ স্বত্বার প্রতি ভালোবাসার যেন কমতি না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এই জীবন শুধুই একটি ভ্রমণ যাত্রা, কোনো প্রতিযোগিতা নয়। ‘জীবন যাত্রায় তুমি হেরে গিয়েছ’ এই উক্তিটি সমাজের লোকজনই বলে থাকে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা কিন্তু কোনোদিন আমাদের বলেন নি এই কথা। তিনি যেমন সর্বদা আমাদের ওপর থেকে দেখছেন, ঠিক তেমনিভাবে আমাদের সর্বদা সুখে রাখার দায়িত্বও তার। মাঝে মাঝে আমাদের জীবনে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়, নানা পরীক্ষা দিতে হয়। তবে মনে রাখতে হবে, অন্ধকারের পরেই আলো ফিরে আসে, রাতের পর যেমন আসে দিন, আকাশে ওঠে সূর্য। যতই বাধা বিপত্তি থাকুক না কেন, সবারর জীবনে আলো এবং সফলতা একদিন আসবেই। আমরা যদি কষ্ট করি তার বিনিময়ে আমরা পুরষ্কারও পাব। তাই নিরাশ না হয়ে, মুখে হাসি রেখে, মনে প্রশান্তি নিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবিরাম গতিতে ছুটে চলতে দেওয়াই হবে উত্তম কাজ। তাই কেতাবী শিক্ষা, সাটিফিকেট নির্ভর শিক্ষার পরিবর্তে মানবিক ও নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বিজ্ঞান মনস্ক জাতি গঠনে সবাইকে মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক।

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close