আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ১৩ মে, ২০২২

পর্যবেক্ষণ

নেয়ামতে ভরা গ্রীষ্মকাল

মানুষ আগমনের বহু আগ থেকেই করুণার আঁধার আল্লাহতায়ালা তার অপার নেয়ামতে এই ধূলির ধরণিকে ভরপুর করেছেন। করেছেন মানুষের বসবাসযোগ্য। মানুষ যেন সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপন করতে পারে, সেজন্য যা কিছুর প্রয়োজন, তার সবকিছুই তিনি এ বিশ্বলয়ের পরতে পরতে বিছিয়ে দিয়েছেন। তিনি যেমনিভাবে সেজেছেন আলো-ছায়া, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত, ঝর্ণাধারা আর নির্মল বাতাস, তেমনি ফুল-ফসল আর পত্রপল্লবের অনুপম সৃজনে প্রকৃতিকে করেছেন নয়নাভিরাম। আর ঋতুবৈচিত্র্যের পালাবদলে রেখেছেন অনন্য নিদর্শন। বিশেষ করে আমাদের এই ষড়ঋতুর বাংলাদেশের রূপবৈচিত্র্য যেন মহামহিমের এক বিশেষ করুণার ঢালি।

ছয় ঋতুর ভিন্ন ভিন্ন রূপে সজ্জিত রূপসী বাংলার এই রূপমাধুর্য তিনি শুধু আমাদেরই দিয়েছেন। আমাদের এই ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময় অফুরন্ত রূপ, রস আর কোথাও নেই। তাই কবি বলেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি।’ ষড়ঋতুর এই বিমুগ্ধ সুভাষ বাংলার প্রকৃতিকে সাজায় নতুনত্বের আল্পনায়। সেই আল্পনার বিমোহিত পালাক্রমে বাংলার প্রকৃতিতে প্রথমেই যার আগমন, তার নাম গ্রীষ্ম।

গ্রীষ্মকালের নাম শুনলেই আমাদের চোখের পাতায় রৌদ্রদগ্ধ প্রকৃতির যেই ঝলসানো দৃশ্য ফোটে উঠে, গ্রীষ্ম কিন্তু ততটাই তপ্ত মেজাজের নয়। বরং গ্রীষ্মেরও আছে বিমুগ্ধ রূপ-রস। গ্রীষ্মের একমুঠো দুরন্ত বাতাসের ঝিরিঝিরি সুর, নৃত্যরত সবুজ পাতার ঢেউ, সোনালি ধানের শিষ, দুপুরের উদাস নির্জনতা, মৌন বিকালে ধুলোর মেঘ, সন্ধ্যায় রক্তিমাকাশ আর রাতের হাসনাহেনার সুবাসিত ঢেউয়ে দোল লাগে না- এমন হৃদয় আছে? গ্রীষ্মের এই বিমোহিত রূপমাধুর্য হৃদয় ভরিয়ে দেয় আনন্দের হিল্লোলে। গ্রীষ্মের এই নান্দনিকতাকে ফুলেল সৌন্দর্যে প্রফুল্লিত করতে প্রকৃতিতে ফোটে অসংখ্য জাতের ফুল। স্বর্ণাভ সোনালু, বেগুনি রঙের জারুল, রক্তিম গুলবাহার, মনোমুগ্ধকর কাঠগোলাপ, ডুলিচাপা, উদয়পদ্ম, মধুমঞ্জুরি, হিজলসহ বাহারি ফুলের চোখজুড়ানো দৃশ্যে গ্রীষ্মের খরতাপ উবে যায় নিমিষেই। ফুলের সিক্ততায় ভিজে উঠে হৃদয়ের করিডর।

গ্রীষ্ম কিন্তু শুধু ফুল দিয়েই নিজের সমাপ্তি টানে না, বরং ফল-ফসলেও ভরিয়ে দেয় প্রকৃতির আঁচল। গ্রীষ্মের প্রথম মাস ‘বৈশাখ’ ফুলের সুভাষ কাটতে না কাটতেই হাজির হয় মধুমাস ‘জ্যৈষ্ঠ’। আর জ্যৈষ্ঠ মানেই গাছে গাছে সবুজ পাতার ফাঁকে দোল খাওয়া সূর্যমুখী আম আর টকটকে লাল লিচু। গ্রীষ্মের তপ্তদাহের তৃষ্ণার্থ প্রাণকে শীতলতার পরশ বোলাতে রয়েছে বাঙ্গি ও তরমুজ। এ ছাড়াও গ্রীষ্মের রসাল ফলের মধ্যে রয়েছে আনারস, আমলকী, আতা, করমচা, জামরুল, বেল, গাব, কালো জাম, খুুদিজামসহ নানা জাতের ফল। এসব বাহারি ফলের ম ম গন্ধে মোহিত হয়ে উঠে প্রকৃতির চারপাশ।

গ্রীষ্মের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সোনামাখা ধান। পাকা ধানে ভরে ওঠা কৃষকের গোলা। ব্যস্ত কিষানির ঠোঁটে লেগে থাকা এক চিলতে হাসির ঝিলিক। আর ওসবই বিশ্ব প্রতিপালক মহান আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত কৃপা। যিনি এই শক্ত মাটির বক্ষ চিড়ে বের করে আনেন সবুজ বৃক্ষ। বৃক্ষ থেকে ফুল, ফুল থেকে ফল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক, আমি আশ্চর্য উপায়ে পানিবর্ষণ করেছি। এরপর মাটিকে বিদীর্ণ করেছি। অতঃপর তাতে উৎপন্ন করেছি শস্য, আঙুর, শাকসবজি, জয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্‌যান , ফল এবং ঘাস তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুদের উপকারার্থে।’ (সুরা আবাসা, আয়াত : ২৪-৩২)।

এই যে এত সব নেয়ামতে পরিপূর্ণ গ্রীষ্মকাল, তাকে কেন আমরা শুধু তপ্তদাহের চিত্রেই অঙ্কিত করছি? বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দুই মাস বৈশাখ আর জ্যৈষ্ঠ মিলে গ্রীষ্মের পরিধি হলেও আমরা কেন কেবল ‘বৈশাখ’ নিয়েই মেতে উঠি? বৈশাখ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় এতসব আয়োজন করা হলেও গ্রীষ্ম নিয়ে ভাবারও ফুরসত হয় না আমাদের। কিন্তু কেন? কেন বৈশাখের মতো গ্রীষ্ম নিয়েও কোনো আয়োজন থাকে না ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়ায়? থাকে না সংস্কৃতিবানদের ছোট্ট একটি সেমিনার। রচিত হয় না কবিতার দুটি লাইন। যেমনটা লেখা হয় বর্ষা, শরৎ অথবা ঋতুরাজ বসন্তকে নিয়ে। যদিও স্বাতন্ত্র্যভাবে ‘বৈশাখ’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘এসো হে বৈশাখ’ আর নজরুল লিখেছেন ‘প্রলয়োল্লাস’।

হ্যাঁ, গ্রীষ্ম নিয়েও কিছু লেখাজোখা হয়েছে। কিন্তু সেসব লেখায় গ্রীষ্মের তপ্ততাই কেবল ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ কথা সত্য যে, গ্রীষ্মকালে তাপ একটু বেশিই লাগে। তবে এই তপ্ততার মধ্যেও আমাদের উপকারিতার শেষ নেই। ভেবে দেখুন তো! যদি গ্রীষ্মের এই উত্তাপ না থাকত, তাহলে গাছের কাঁচা ফলগুলো পাকত কেমন করে? ধানগুলোইবা গোলায় উঠত কী করে? সুতরাং এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গ্রীষ্মের এই তপ্তাদহও আমাদের জন্য নেয়ামত বিশেষ। অথচ আমরা সেই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে এর কুৎসা রটাচ্ছি। গ্রীষ্ম থেকে ‘বৈশাখ’ আলাদা করে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, মিডিয়াসহ সবখানেই একে জামাই আদর করছি। হ্যাঁ, নববর্ষ বা বছরের প্রথম মাস হিসেবে বৈশাখের আলাদা একটা গুরুত্ব আছে- এ কথা সত্য। কিন্তু তারও তো একটা সীমারেখা আছে। আছে ধর্মীয় কিছু বিধিবিধানও। এখানে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ধর্মকে টেনে আনছি কেন? ধর্মকে পাশ কাটিয়ে সংস্কৃতির অস্তিত্ব কোথায়? ধর্মই তো সংস্কৃতির মূল উপাদান। ধর্মকে বাদ দিয়ে পৃথিবীতে যতগুলো সংস্কৃতির উত্থান হয়েছে, তা সমাজব্যবস্থার কোনো উপকারে আসেনি। সেজন্য সমাজ এসব সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আর এই যে নববর্ষ নববর্ষ বলে মুখে খই ফোটাচ্ছি, এই নববর্ষেও যে মিশে আছে ধর্মেরই নির্যাস। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সম্রাট আকবর কৃষিপণ্যের খাজনা আদায় করতে যে সন প্রর্বতন করেন, অর্থাৎ আমাদের আজকের এই বাংলা সন, তা কিন্তু হিজরি পঞ্জিকা অনুসারেই বির্নিমাণ হয়েছে। আর এর বিনির্মাণকারী হলেন তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতিবিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হলেও এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। তখন এই সনের নাম ছিল ‘ফসলি সন’। পরে তা বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়। তখনকার সময়ে পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে কিছু অনুষ্ঠান হতো ঠিক, কিন্তু সেসব অনুষ্ঠান এখনকার মতো বেলেল্লাপনা ছিল না। সেসময় প্রজারা চৈত্র মাসের শেষ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করতেন এবং পহেলা বৈশাখে জমিদাররা প্রজাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা পহেলা বৈশাখে ‘হালখাতা’ করতেন। এই-ই

ছিল নববর্ষের উৎসব। আর এ ধরনের উৎসবকে ইসলামও নিষিদ্ধ করে না। কিন্তু বর্তমানে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে সংস্কৃতির নামে এমন কিছু অপসংস্কৃতির সংযোজন করা হচ্ছে; যা বেলেল্লাপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। আবার কিছু কিছু কর্মকান্ড রয়েছে, যা শুধুই হাস্যকর। এই যেমন- পান্তা-ইলিশ, মঙ্গল শোভাযাত্রা, সুতরাং এগুলোকে হাজার বছরের ঐতিহ্য বলার কোনো অবকাশ নেই। বরং এসবের অধিকাংশই আমাদের মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে প্রচন্ডভাবে সাংঘর্ষিক। তবে ভিন্নধর্মীরা যদি এসব অনুষ্ঠান পালন করতে চায় তো তারা করুক। এতে আমরা বাধা দেব না। সে অধিকার ইসলামও আমদের দেয়নি। ইসলাম বলে, ‘তাদের কর্ম ও কর্মফল তাদের জন্য এবং আমাদের কর্ম ও কর্মফল আমাদের জন্য।’ (সুরা কাফিরুন, আয়াত : ৬)

আসুন! সত্যকে উপলব্ধি করি। ছিন্ন করি স্রেফ বৈশাখ নিয়ে গতানুগতিকতার মায়াজাল। গ্রীষ্মও যে আমাদের শুধু দগ্ধ করতেই আসে না, আসে ফুল, ফল আর ফসলের প্রাপ্তিতে আমাদের ভরিয়ে দিতে, তা স্বীকার করি। নতুবা আল্লাহর এই অফুরন্ত নেয়ামতের অশুকরিয়া হবে; যা আমাদের জন্য কখনোই শুভনীয় নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

খতিব, কসবা মসজিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close