মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২৮ মার্চ, ২০২০

মতামত

বোধোদয় হওয়াটাই আজ জরুরি

‘ঘরের দরজা খোলা রেখে’ বা ‘গরু ছেড়ে দিয়ে’ এই (তাওয়াক্কুল) ধারণা অথবা ভরসা করা বৈধ নয় যে, আল্লাহ রক্ষা করবেন। মাঠে বীজ রোপণ ও যথাসময়ে নিড়ানি-কোপানি করেই সৃষ্টিকর্তার কাছে ভালো ফসলের আশা ও প্রার্থনা করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী এমন অভূতপূর্ব পরিস্থিতি ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়নি। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৫ লাখেরও বেশি মানুষ, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবে বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে বিশ্বের ১৭৬টি দেশ ও অঞ্চল। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে দুনিয়ার অনেক দেশ ও শহর।

বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা (র.) ৭৪৯ হিজরির দামেস্কের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে মহামারির ফলে পথে-ঘাটে মানুষ মরে পড়েছিল। আকাশে শকুন উড়ছিল। বড় বড় গর্ত খুঁড়ে লাশগুলো টেনে গর্তে নামানো হচ্ছিল। এ সময় মুসলমানরা সবাই কোরআন হাতে পথে বেরিয়ে আসে। তিন দিন সবাই রোজা রেখেছিল। খ্রিস্টানরা বাইবেল হাতে, ইহুদিরা তাওরাত হাতে পথে নেমে আসে। সম্মিলিতভাবে সবাই মহান প্রভুর কাছে মিনতি করে। অবশেষে আল্লাহতায়ালা রহম করেন।

করোনা অবশ্যই ছোঁয়াছে ও সংক্রামক ব্যাধি। কাজেই সব ধরনের সমাগম পরিহার করে চলতে হবে। সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক হতেও রাসুল (সা.) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেওয়া হবে না (রুগ্ন উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না)। (বোখারি, মুসলিম)। এছাড়া বর্ণিত হয়েছে, ‘যদি তোমরা শুনতে পাও, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছো, তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না। (বোখারি, মুসলিম)। এভাবে রাসুল (সা.) প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সংক্রমণ প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ (quarantine) ব্যবস্থার নির্দেশনা দেন।

মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেননি। ইসলামের যাবতীয় নির্দেশনার সময় এবং যুগোপযোগী। সুরা বাকারার ২৮৬ নম্বর আয়াতটি নিয়ে আমরা যদি গভীরভাবে চিন্তা করি, জীবন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যেতে বাধ্য। ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ চাপিয়ে দেন না। সে যা ভালো কাজ করেছে তার ফল পাবে এবং যা খারাপ করেছে, তা তার বিরুদ্ধে যাবে...। যে লোকের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, সে এই মহামারিতে আক্রান্ত, তার জন্য মসজিদে গমন করা জায়েজ নেই। মসজিদে নামাজে গেলে যত কম সময়ে নামাজ আদায় করা যায়, ততই ভালো। ফরজ নামাজের আগের ও পরের সুন্নতগুলো ঘরে পড়ে নেওয়া। আর ইমাম সাহেব যেন এই দুর্যোগকালে নামাজের কিরাত ও জুমার খুতবা সংক্ষিপ্ত করেন। শরিয়তে খুতবার ক্ষেত্রে সহজতর বিধান রয়েছে। দুর্যোগের সময় নামাজের কাতারের মধ্যে কিছুটা ফাঁক বা দূরত্ব অবলম্বন করা। মসজিদগুলো থেকে কার্পেট-নামাজের বিছানা ইত্যাদি উঠিয়ে দেওয়া। কারণ, ওসবে জার্ম ও জীবাণু লেগে থাকার সম্ভাবনা প্রবল। মুসাফাহা করা মুস্তাহাব আমল। আর সালাম প্রদান হলো জরুরি। সুতরাং যেখানে মুসাফাহা করলে কারো অপকার বা ক্ষতির আশঙ্কা আছে, সেখানে মুসাফাহা করা ঠিক নয়।

ছোঁয়াচে রোগ বা রোগের সংক্রমণ নিয়ে অতি বাড়াবাড়ি বা ছড়াছাড়ি করতে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বা বিচ্ছিন্ন কোনো একটি গুজব শুনে বাড়াবাড়ি করা শুভকর নয়। সমসাময়িক কোনো বিষয় নিয়ে ইসলামের একটি ব্যাখ্যা শুনেই বাড়াবাড়ি বা কোনো একটি ব্যাখ্যাকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে চরম কঠোর হয়ে যাওয়া মোটেও ঠিক নয়। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া করোনাভাইরাস নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণে অস্থির ও আতঙ্কে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে মানুষের মন। ইসলাম এমন একটি জীবন ব্যবস্থার নাম, যেখানে মানবতার কল্যাণ ও সফলতার জন্যÑ স্থান, কাল, সময়ভেদে যে স্থানে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার, সেখানে তাই করতে বলা হয়েছে। যেসব রোগের বিস্তারে সংক্রমণ একটি উপায় বলে নিশ্চিত জানা যায়, সেসব রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র ও সরকারকে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হয়ে সর্বসাধারণের সর্বোচ্চ সহায়তা করা একান্ত আবশ্যক। উন্নত বিশ্বে রয়েছে প্রচুর চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। সেই তুলনায় আমাদের অবস্থা কেমন, তা বলার অবকাশ রাখে না। আমাদের প্রয়োজন হতে পারে অনেক স্বেচ্ছাসেবী। সময় হয়েছে দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে ধার্মিক ও মানবিক বোধে উজ্জীবিত হয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে অসুস্থদের সেবায় প্রস্তুত থাকার।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের মৌলিক নির্দেশনা ও ইমানের অঙ্গ। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার প্রতিও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কারণ, পরিবেশ দূষণের কারণে মানবসমাজে বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়ায়। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার চেয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম।’ আধুনিক যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞান ইসলামের সেই থিওরি স্বীকার করে ঘোষণা করে, ‘রোগ প্রতিরোধ রোগ নিরাময়ের চেয়ে শ্রেয়’। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র লোকদিগকে ভালোবাসেন। এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং ভালোবাসেন তাদের, যারা অত্যধিক পবিত্রতা অর্জনকারী।’ (বাকারা-২২২)।

দৈহিক বা শারীরিক পবিত্রতার জন্য ইসলামি শরিয়তে রয়েছে অজু। ইসলামে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে মহান আল্লাহ অজু করার সময় এমন চারটি অঙ্গকে ধোয়া ফরজ করেছেন, যে চারটি অঙ্গের মাধ্যমে শরীরে দ্রুত ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। ‘হে মুমিনরা! যখন তোমরা নামাজের জন্য প্রস্তুত হও, তখন তোমরা তোমাদের মুখম-ল ও হাত কনুই পর্যন্ত ধৌত করো এবং তোমাদের মাথা মাসেহ করো আর পা টাখনু পর্যন্ত প্রক্ষালন করো...’ (মায়িদাহ-৬)। পাশাপাশি যে পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা হবে, সেই পানিও হতে হবে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ। যে পানির স্বাদ, গন্ধ ও রং অবিকৃত থাকবে। এছাড়া অজুর শুরুতে কবজি পর্যন্ত দুই হাত ধোয়া, কুলি করা, দাঁত মিসওয়াক করা, কান ও নাকের বহির্ভাগ পরিষ্কার করাকে মহানবী (সা.) তাঁর সুন্নত হিসেবে অনুসরণ করতে বলেছেন।

সঠিক নিয়মে হাত ধোয়ার অভ্যাস একটি ভালো ভ্যাকসিনের চেয়ে বেশি কাজ করে। তাই দেড় হাজার বছর আগে খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধৌত করার প্রতি ইসলামের নির্দেশ এসেছে। ‘রাসুল (সা.) পানাহারের আগে উভয় হাত কবজি পর্যন্ত ধুয়ে নিতেন’। আবার পায়খানা থেকে পানি খরচ করার পর বাইরে এসে মাটিতে হাত মলার অভ্যাস ছিল প্রিয় নবীজীর।

অজু দ্বারা সওয়াব বা নেকি অর্জনের পাশাপাশি জাগতিক উপকারও রয়েছে। যেমনÑ দৈনিক পাঁচবার নামাজের জন্য অজু করলে এবং প্রতিবার আহার গ্রহণের আগে অজু করলে নানা ধরনের ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ থেকে সুরক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ ইসলামে নিষিদ্ধ। কারণ তাতে রোগব্যাধি ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তিন অভিশপ্ত ব্যক্তি থেকে বেঁচে থাকো। তারা হলোÑ যে পানির ঘাটে, রাস্তার ওপর ও গাছের ছায়ায় মলমূত্র ত্যাগ করে।’ (আবু দাউদ)।

সর্বধর্মেই যেমন মানুষের সেবা করতে জোর তাগিদ রয়েছে, তেমনি ইসলাম মানুষকে আল্লাহর ওপর ইমান আনা এবং তাঁর ইবাদতের ওপর যেমন জোর দেয়, তেমনি মানুষের সেবা করতেও জোর তাগিদ দিয়েছে। ইসলামে একে অপরের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলাও ইবাদত বলে গণ্য। এসব আচরণ ও পেশাগত ইবাদতের পক্ষে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে। রাসুল (সা.) তাঁর সমগ্র জীবনে সাহায্যপ্রার্থীর প্রতি অকৃপণভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। “রাসুল (সা.) জীবনে কখনো কোনো সাহায্য-প্রার্থীকে ‘না’ বলেননি।” মানবসেবাকে তিনি তার জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কোনো অবস্থায় এ ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি। মদিনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও তিনি বিলাসী জীবনযাপন করেননি। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর কাছে যেসব উপহার আসত, তিনি তা গরিব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিতেন। ইসলামে মানবসেবাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত আরেকটি হাদিসে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য...’ (বোখারি, মুসলিম)।

প্রতিরোধক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দূরারোগ্য কিংবা মহামারি থেকে একমাত্র আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়াটাই সর্বোত্তম পন্থা। এমন পরিস্থিতিতে সব সময় এ দোয়াটি পড়ার অভ্যাস করা সমীচীন, যা রাসুল (সা.) শিখিয়ে দিয়েছেনÑ ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল বারাসি, ওয়াল জুনুন, ওয়াল ঝুজাম, ওয়া মিন সায়্যিল আসকাম’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)। অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আপনার কাছে আমি আশ্রয় চাই শ্বেতরোগ থেকে, মাতাল হয়ে যাওয়া থেকে, কুষ্ঠ রোগ থেকে ও দুরারোগ্য ব্যাধি (যেগুলোর নাম জানি না) থেকে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close