সি. মেবেল কস্তা আরএনডিএম

  ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শিক্ষাজীবনে মূল্যবোধের গুরুত্ব

মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মহান সৃষ্টিকর্তা অত্যন্ত দক্ষ হাতে, সুনিপুণভাবে, অতিযত্নে পরম মমতা দিয়ে তার সবচেয়ে উত্তম সৃষ্টি মানুষকে নিজের প্রতিমূর্তিতে ও সাদৃশ্যে গড়ে তুলেছেন।

পরিবারে মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অসহায়তাবোধ চিরাচরিত নিয়মেই ঘটে এসেছে। একটি পরিবারে শিশু জন্ম হওয়ার পর সে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে। সন্তানকে লালনপালন, ভরণপোষণ এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষ রূপে গড়ে তোলার পেছনে যে অবদান বা ভূমিকা তা মা-বাবা পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের ওপর বর্ষিত। সন্তানদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, চালচলন সবই পরিবার থেকে আসে। পরিবারই হলো শিশুর মানবীয় গঠনের কেন্দ্র।

‘এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কবিতার এই দুটি পঙক্তিতে লুকিয়ে আছে মানবজীবনের চরম সত্য। শিশু পরিবার থেকে স্নেহ, ভালোবাসা, শ্রদ্ধাভক্তি, সহভাগিতা, অন্যকে ক্ষমা করা, ধর্মীয় রীতিনীতি ও মূল্যবোধ শিখে। মানবীয় গঠনের প্রধান ভিত্তি স্থাপিত হয় পরিবারে। পরিবারের শিক্ষাই সারাজীবন লালনপালন করে। পিতা-মাতার মধ্য দিয়েই সন্তান শিক্ষালাভ করে এবং সে মনোভাব নিয়ে বড় হয়ে ওঠে।

বর্তমানে পরিবার অনেক দিক দিয়েই হুমকির সম্মুখীন। সত্যিকারের পারিবারিক মূল্যবোধের ঘাটতি লক্ষ করা যায় এবং সে কারণে অনেক পরিবারের যে বাস্তব চিত্র তা আমাদের শঙ্কিত করে। সঠিক ও যথাযথ পারিবারিক মূল্যবোধে একটি পরিবার আদর্শ পরিবার হতে পারে। পিতা-মাতা ছেলেমেয়েদের শেখাবেন সত্য কথা বলা, ভালোমন্দ বিচার করে সত্যতা যাচাই, সহমর্মিতা, দয়া, ক্ষমা করা ও শান্তির মনোভাব। কিন্তু বর্তমান যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একদিকে মানুষকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সত্য, কিন্তু সেখানে যারা সচেতন নয় তারা সমস্যা, সংকট ও অশান্তির মধ্যে বসবাস করছে। সে জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের এই মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে এবং চর্চা করাতে হবে।

আজকাল ছেলেমেয়েরা বেশির ভাগ সময়ই নিজেদের মতো চলতে চায়। অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষকদের কথাও শুনতে বা মানতে চায় না। সে জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষা দিতে হবে। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, তার পাশাপাশি পাঠ্যবই বা সিলেবাসের ঊর্ধ্বে গিয়ে Faith Formation, Value Foemation -এর ওপর জোর দেওয়া এবং সেই আদর্শে জীবনযাপন করতে বিশেষ সহায়তা দেওয়া ও শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের।

যে পরিবারে সঠিক মূল্যবোধের চর্চা ও পরিচর্যা হয় সে পবিরার দিনে দিনে একটি আদর্শ পরিবার হয়ে ওঠে। বর্তমানে অনেক পরিবারেই পারিবারিক মূল্যবোধের ঘাটতি লক্ষ করা যায়। সে কারণে শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুল-কলেজগুলো বর্তমানে শঙ্কিত। যে পরিবারের সন্তানরা মূল্যবোধগুলো যেমন : শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসা, সততা, বিশ্বস্ততা, ধৈর্যশীলতা, ক্ষমা, সমর্থন, দায়িত্বশীলতা, পরিশ্রম, দয়া, করুণা, প্রশংসা, মার্জিতবোধ ইত্যাদি গুণাবলি অনুশীলন করে তারা জীবনে সফলতা লাভ করে। পরিবারই হলো মূল্যবোধচর্চার প্রথম জায়গা। প্রত্যেক শিশুই তার শৈশবকাল পেরিয়ে বৃহত্তর পরিসরে অবতীর্ণ হয়। একজন পরিপক্ব মানুষের পরিচয় তুলে ধরার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে বিস্তারের পাশাপাশি তা পালন করা হয়। শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষকদের।

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে এক ধরনের সুন্দর সমন্বয় করে শিক্ষাদান করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সে অবস্থা নেই। দেশে বিদ্যমান পুরাতন শিক্ষাব্যবস্থা এই মহৎ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীরা দিন দিন মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ একান্ত দরকার। তবে বর্তমান সরকার ২০২১ সাল থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণমূলক দলগত কাজের মাধ্যমে হাতে-কলমে শিক্ষা অর্জন করছে। তাতে আমরা আশা করতে পারি শিক্ষার্থীরা সঠিক মূল্যবোধ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পরিবার, সমাজ তথা দেশের জন্য সুনাগরিক হয়ে উঠবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক তার শিক্ষকতার দায়িত্ব ভালোভাবে পালন ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ উন্নয়নে ও প্রতিটি শিক্ষার্থীকে জানা বোঝা ও গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত দরকার। আমাদের সমাজে বর্তমানে দেখা যাচ্ছে তারা জীবনযাপন করছে ভিন্নভাবে। তাই শিক্ষককে মূল্যবোধের প্রতি যত্নবান হওয়া উচিত। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে মূল্যবোধ বিকাশের জন্য সর্বাত্মক ভূমিকা রাখতে হবে।

সমাজের ঘূণে ধরা মূল্যবোধকে আবার শিক্ষকরাই পারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগিয়ে তুলে সঠিক গঠন দিতে। স্কুল-কলেজে যখন কোনো শিক্ষার্থী আসে প্রথমেই তারা চিন্তা করে গণিত, বিজ্ঞান, সমাজ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই বা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা মূল্যবোধের বিষয়টি দেখি না। তাহলে কীভাবে শিক্ষার্থীরা ভালোমন্দ বুঝতে পারবে কেন মূল্যবোধ প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের জন্য মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা কী : ১. শিক্ষার্থীরা সুনাগরিক হয়ে পরিবার, সমাজ তথা দেশের জন্য ভালো আদর্শ উপহার দেবে। ২. সমাজে দেখা যায় অন্যায্যতা, অসততা, দুর্নীতি, বিবাদ লেগেই রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের মনেও প্রভাব ফেলে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি সঠিক ‘মূল্যবোধ’ শিক্ষা দেওয়া হয়, তবে শিক্ষার্থীরা তাদের সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান করতে পারবে। ৩. মূল্যবোধ জীবনকে সুন্দর করে এবং সেই ব্যক্তি যেখানেই যায়, সেখানে শ্রদ্ধা-সম্মান লাভ করে।

শিক্ষা, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক- এই তিনটির মধ্যেই রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন শিক্ষক হলেন মূল্যবোধ গঠনের আদর্শ কারিগর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো শিক্ষার্থীর মূল্যবোধচর্চা করার উত্তম স্থান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালো-মন্দ, বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ, সততা, সমাজসেবা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, দায়িত্বশীলতা প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে থাকে। একটি সুস্থ সুন্দর ও উপযোগী সমাজ তথা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মূল্যবোধের কোনো বিকল্প নেই। পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র পরিচালনায় মূল্যবোধের অনুপস্থিতি আশা করা যায় না।

আজ শিক্ষার্থীরা যা কিছু পরিবারে করে তাই করার চেষ্টা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের সঠিকভাবে শেখাতে হবে। নৈতিক মূল্যবোধ যা ভবিষ্যতে যেখানেই থাকুক না কেন সে হবে নীতিবান, আদর্শবান এবং সেখান থেকেই সে অন্যকেও মূল্যবোধ গঠনে অনুপ্রাণিত করবে। শিক্ষার্থীরা মা-বাবার কথা না শুনলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কথা শোনে। মা-বাবার পর ছেলেমেয়েরা শিক্ষকদেরই তাদের জীবনপথের কাণ্ডারি হিসেবে বিবেচনা করে। মূল্যবোধের প্রতি শিক্ষার্থীদের যত্নবান হতে হবে এবং শ্রেণিকক্ষসহ সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল্যবোধ বিকাশের জন্য ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই আমরা পাব উন্নত সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি।

পরিশেষে বলতে চাই, I can make different. নিজে শুরু করি। তাহলেই আমরা পিতা-মাতা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা মিলে গড়ে তুলব একটি নতুন পৃথিবী। আমাদের সন্তানরা হয়ে উঠবে একজন মূল্যবোধসম্পন্ন, দুর্নীতিমুক্ত, আদর্শবান, আলোকিত সুনাগরিক।

লেখক : অধ্যক্ষ, সেন্ট ইউফ্রেজিস বালিকা উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close