জাহিদুল ইসলাম

  ১২ মে, ২০২৪

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সে পরিবারতন্ত্র

সরকার তথা বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিমা খাতে পরিবর্তন না আসার অন্যতম কারণ হিসেবে এক পরিবারের হাতে ক্ষমতা বা পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাকে মনে করা হয়। পরিচালনা পর্ষদের অধিকাংশ সদস্যই এক পরিবারের সদস্য হওয়ায় নিজেদের যেকোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় বাধা ছাড়াই। সর্বশেষ সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সেও তেমনটাই দেখা গেছে। এবার আরেক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডেও এই পরিবারতন্ত্র চলছে বলে জানা গেছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে নিশ্চুপ রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাধারণ বিমা খাতের এই কোম্পানিটি দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন। প্রতিষ্ঠানটিতে ১০ জন উদ্যোক্ত পরিচালক ও ৫ জন শেয়ারহোল্ডার পরিচালকসহ ১৯ জন পরিচালক রয়েছেন। এর মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের ৬ জন সদস্য তথা এক-তৃতীয়াংশই কোম্পানির চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের পরিবারভুক্ত। এক্ষেত্রে মানা হয়নি আইনি বাধ্যবাধকতা। এমনকি পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত হতে সুনির্দিষ্ট যে যোগ্যতা থাকতে হয়, সে শর্তও পালন না করার অভিযোগ রয়েছে কোনো কোনো পরিচালকের বিরুদ্ধে।

আইনে এক পরিবারের সর্বোচ্চ ২ পরিচালক, অথচ রয়েছে ৬ জন : এ বিষয়ে জানা গেছে, বিমা আইন অনুসারে এক পরিবার থেকে সর্বোচ্চ ২ জন পরিচালক থাকার বিধান রয়েছে। বিমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা অনুসারে, কোনো বিমাকারীর পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবার থেকে দুজনের অধিক পরিচালক থাকতে পারে না। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার প্রণীত এই আইন ও বিধানের কোনো তোয়াক্কা করছে না কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ। কোম্পানির চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল নিজেসহ পরিবারের অন্য যেসব সদস্য পরিচালক হিসেবে রয়েছেন তারা হলেন চেয়ারম্যানের স্ত্রী বিউটি আক্তার, মেয়ে তাহমিনা বিনতে মোস্তফা, তানজিমা বিনতে মোস্তফা ও তাসমিন বিনতে মোস্তফা এবং ছেলে তানভির আহমেদ মোস্তফা।

পরিচালক হতে মানা হয়নি যোগ্যতার শর্ত : অপরদিকে বিমা আইনে পরিচালকের যে যোগ্যতার শর্ত উল্লেখ করা হয়েছে তাও মানছে না প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটিতে সর্বকনিষ্ঠ পরিচালক হিসেবে আছেন মোস্তফা কামালের ছোট মেয়ে তাসনিম বিনতে মোস্তফা। বিমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা, ২০১৩ এর ৩(২) (খ) ধারার বীউনিক-খ ফরম এর ১১ অনুসারে, কোনো বিমাকারীর পরিচালক হতে হলে ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু বিএনআইসির পরিচালক তাসনিম বিনতে মোস্তফার উল্লেখিত যোগ্যতা নেই বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক প্রতিবেদনে পরিচালকদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্তে জানা যায়, তিনি ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পরে ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, তিনি সে সময় প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক হিসেবে ছিলেন। অর্থাৎ ২০১৬ সালে তার বয়স ছিল ১৮ বছর। কিন্তু বিমাকারীর পরিচালক হতে গেলে তার ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকা বাধ্যতামূলক। এই অভিজ্ঞতা পূরণ করতে গেলে তাকে ৮ বছর বয়সেই কোম্পানি পরিচালনায় সম্পৃক্ত থাকতে হবে, যেটা সম্ভব নয়। ফলে ২০১৩ সালে নিবন্ধন প্রবিধানমালা হওয়ার পরও ২০১৬ সালে এসে সেই বিধান ভেঙে পরিচালক হয়েছিলেন তাসনিম বিনতে মোস্তফা।

আইন ভেঙে চেয়ারম্যান পরিবারের হাতে বিপুল শেয়ার : শুধু তাই নয়, এক পরিবারের হাতে বিপুলসংখ্যক শেয়ার কুক্ষিগত করেও প্রতিনিয়ত আইন ভাঙছে এই প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৪ কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার শেয়ারের মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৬০ দশমিক ১৩ শতাংশ বা ২ কোটি ৬৬ লাখ ৮ হাজার ৮২০টি শেয়ার। এর মধ্যে চেয়ারম্যান মোস্তফা কামালের নিজের ২৪ লাখ ২৪ হাজার ৮৩৩টি বা ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, চেয়ারম্যানের স্ত্রী বিউটি আক্তারের ১০ লাখ বা ২ দশমিক ২৬ শতাংশ, মেয়ে তাহমিনা বিনতে মোস্তফার ৩৩ লাখ ৮ হাজার ৩৩৪টি বা ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ, তানজিমা বিনতে মোস্তফা ৩২ লাখ ৮ হাজার ৩৩৪টি বা ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ, তাসমিন বিনতে মোস্তফা ১০ লাখ বা ২ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং একমাত্র ছেলে তানভির আহমেদ মোস্তফা ৪১ লাখ ৭৫ হাজার ১৬৭টি বা ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ শেয়ার ধারণ করেছে। এই ৬ জনের সম্মিলিত শেয়ার ধারণের পরিমাণ ১ কোটি ৫১ লাখ ১৬ হাজার ৬৬৮টি বা মোট শেয়ারের ৩৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।

তবে বিমাকারীর মূলধন ও শেয়ার ধারণ বিধিমাল, ২০১৬ এর ৩(৫) অনুসারে, কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ একক বা যৌথভাবে অথবা কোনো কোম্পানি কোনো বিমাকারীর শতকরা ১০ (দশ) ভাগের বেশি শেয়ার ধারণ করবে না। কেউ যদি নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত শেয়ার ধারণ করে তবে অতিরিক্ত ধারণকৃত শেয়ার এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে হবে, যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিক্রি করা না যায়, তবে বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানাতে হবে। এরপর নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে সরকারকে অবহিত করলে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা ওই অতিরিক্ত শেয়ার কিনে নেবেন। কিন্তু যত দূর জানা যায়, এ বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে যেমনিভাবে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে জানানো হয়নি, তেমনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকেও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়নি।

কোন কারণে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ কৌশল : এত অনিয়মের মাধ্যমে কেন পরিবারের সদস্যদের পরিচালক করতে হবে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি অনুধাবনে কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনের দিকে নজর দেওয়া যাক। আর্থিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি বিমা আইন লঙ্ঘন করে বাকিতে ব্যবসা করছে। কিন্তু জবাবদিহির শঙ্কা না থাকায় এ বিষয়ে নেই কোনো ভ্রুক্ষেপ। আবার বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্ধারিত ব্যয়সীমা ভেঙে অতিরিক্ত ব্যয়েরও অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি কো-ইন্স্যুরার হিসেবে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে পাওনা (অ্যামাউন্ট ডিও টু আদার পারসন অ্যান্ড বডি) থাকলেও তা আদায় করতে পারছে না। অথচ বিভিন্ন জনের কাছে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দেনার পরিমাণ। এই পাওনা আদায়ে কোম্পানি সচেষ্ট হলে তা বিনিয়োগ করলে প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের পক্ষে লাভজনক হতো।

আইনে নিষিদ্ধ হলেও করছে বাকি ব্যবসা : সর্বশেষ ২০২৩ সালে প্রকাশিত ২০২২ সালের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ওই বছর মোট ১০০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম আয় করে। কিন্তু ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট থেকে দেখা যায়, প্রিমিয়াম ও অন্যান্য আয় বাবদ প্রতিষ্ঠানটি নগদ আয় করে ৭২ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ১০০ কোটি টাকা ব্যবসা করলেও অন্যান্য আয় ও প্রিমিয়াম আয়সহ নগদ আয় করে ৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্যান্য আয়ের ক্ষেত্রে সুদ, মুনাফা, লভ্যাংশ ও কমিশনের নগদ আয় বাদ দিলে নগদ প্রিমিয়াম আয় ৫০ কোটি টাকারও নিচে নামবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ব্যবসা দেখালেও এই নগদ অর্থ না পাওয়াকেই ইন্স্যুরেন্সে বাকি ব্যবসা বলা হয়, যা বিমা আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বিমা আইনের ১৮(৩) ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সাধারণত প্রিমিয়ামের টাকা না নিয়ে পলিসি ইস্যু ও পরবর্তীতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে দাবির নামে টাকা আত্মসাৎ বন্ধে বিষয়টিকে বিমা আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সে বিধান মানছে না বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স।

সীমার অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় : এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সীমা ভেঙে ব্যয় করারও অভিযোগ রয়েছে। নন-লাইফ ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ প্রবিধানমালা-২০১৬ এর ৩(১) ধারা অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি অগ্নি, মোটর, নৌ ও বিবিধ বিমার প্রিমিয়ামের বিপরীতে ২৪ কোটি ৮৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা ব্যয় করতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি ৯০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আয় করতে গিয়ে খরচ করেছে প্রায় ২৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এছাড়া এজেন্সি কমিশন বাবদ আরো ১৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকাসহ ৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। ফলে নির্ধারিত সীমার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, যা গ্রোস প্রিমিয়ামের ৪৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

যা বলছে প্রতিষ্ঠানটি : এসব বিষয়ে জানতে প্রতিষ্ঠানটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সানাউল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এই মুহূর্তে আমি একজন গেস্টের সামনে আছি। তাই কথা বলতে পারব না। কখন কথা বলতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি কোন বিষয়ে কথা, সেটা শুনতে চান। অনিয়মের বিষয়গুলো জানালে তিনি এক ঘণ্টা পর ফোন দিতে বলেন। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের পর একাধিকবার ফোন ও মেসেজ করা হলেও তিনি এই প্রতিবেদককে কোনো প্রত্যুত্তর দেননি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close