রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২০

মুক্তমত

উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে দরকার রেলের সংস্কার

উপমহাদেশে রেলওয়ে একটি অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ শাসনামলে এ ভূখন্ডে প্রায় ১৫০ বছর আগে রেলওয়ের জন্ম হয়। সর্ব প্রথম ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়া জেলার দর্শনা-জগতীর ৫৩ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এর যাত্রা হয়। এ লাইন নির্মাণ করেছিল ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়েকে বাংলাদেশ রেলওয়ে নামকরণ করা হয়। ভারত উপমহাদেশে রেললাইন গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ আমলেই। পাকিস্তান আমলে এর কোনো সম্প্রসারণ বা উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশের ৪৯ বছরেও রেলওয়ের সার্বিক অবনতি ঘটেছে। প্রাথমিক অবকাঠামোসহ নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে বাংলাদেশ রেলওয়ে আজ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এ খাতটি এখন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলাচল না করা, ট্রেন ও বগি স্বল্পতা, যাত্রাপথে নিরাপত্তাহীনতা, কম রেললাইন, নোংরা প্ল্যাটফরম ও বগিসহ নানা কারণে বাংলাদেশে রেলভ্রমণ দিনের পর দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। জনবলের অভাবে রেলওয়ের সেবা বিঘিœত হচ্ছে। এসব কারণে দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ের উন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে রেলওয়ের সম্পত্তি গ্রাস, ক্রয় বিভাগের অবাধ দুর্নীতি, দাতাগোষ্ঠীর চাপসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে বর্তমানে একটি মুমূর্ষু প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ট্রেনকে চলাচলের মূল বাহন হিসেবে গড়ে তোলাই এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ। এমনকি দাতা সংস্থার প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশ রেলওয়ের ধ্বংস প্রক্রিয়া চলছে। কিছু সংস্থার পরামর্শে স্টেশন রি-মডেলিংসহ বিভিন্ন প্রকল্পে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু অকেজো বগি মেরামত, ইঞ্জিন ক্রয়, লাইন মেরামত, ডাবল লাইন বা কর্ড লাইন স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বাংলাদেশ রেলওয়ের যাত্রী কমছে, বাড়ছে লোকসান। প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম, অব্যবস্থা ও দুর্নীতি একে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ক্রমাগত যাত্রীসংখ্যা ও পণ্য পরিবহনের হার কমছে। সারা বিশ্ব যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলকে প্রাধান্য দিচ্ছে আর আমাদের দেশে রেলকে অবহেলা করা হচ্ছে। সুশাসনের অভাব প্রকট এ খাতে। স্বাধীনতার পর থেকে রেললাইন বাড়ার বদলে কমেছে। লাইনগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও হয় না। সংস্কারহীন রেললাইনে দ্রুতগতিতে ট্রেন চালানো যায় না। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন ব্যাপকভিত্তিক পদক্ষেপ। রেলের দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে অবিলম্বে রেললাইন সংস্কার করা হোক।

এদিকে অর্থ ও জ্বালানি সাশ্রয়ী, নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব এবং দীর্ঘস্থায়ী যাতায়াত মাধ্যম বাংলাদেশ রেলওয়ের লাইন সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। বছরের পর বছর এই লাইনগুলো সংস্কার না হওয়ায় গত এক বছরে ১৬২টি রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়েছে। এজন্য ঝুঁকিপূর্ণ লাইনে ৫০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। ফলে ব্যাহত হচ্ছে রেলের স্বাভাবিক গতি। তাই অবিলম্বে ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় রেললাইন সংস্কার করা প্রয়োজন। এজন্য রেললাইনে পাথর দেওয়া, সিøপার পরিবর্তন, নাটবল্টু ঠিক আছে কি না, তা নিয়মিত তদারকি করা প্রয়োজন। কারণ পরিবেশবান্ধব রেলপথ আজ প্রায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত। রেলের ভয়াবহ চিত্র দেখলে গা শিউরে ওঠে। এমনকি রেললাইনে কাঠের সিøপার পরিবর্তন, পর্যাপ্ত পাথরের সরবরাহ নিশ্চিত করা, রেললাইনের ভল্ট খোলে চুরি বন্ধ করাসহ অনিয়ম বন্ধ করার জন্য উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। রেলওয়ের সীমানার মধ্যে আবর্জনার স্তূপ অপসারণ, কমলাপুর রেললাইনের দুই ধারে গড়ে ওঠা বস্তি উচ্ছেদ, রেললাইনের ওপর দিয়ে জনসাধারণের অবাধ আনাগোনা, সব অনিয়ম দূর এবং রেলওয়ের আওতাধীন জায়গার সীমানা চিহ্নিত করে সেখানে রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুরু করতে হবে শুদ্ধি অভিযান। দেশের কটি রেলস্টেশন কবে থেকে বন্ধ করা হয়েছে, কী কারণে বন্ধ করা হয়েছে, দেশের সব রেলস্টেশনের তৈরিকৃত বাথরুম কেন বন্ধÑ এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হবে। রেলওয়েতে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা রেলওয়ের লাইন এবং স্টেশন ঘরগুলোর চিত্র ও পরিবেশ দেখলেই ধারণা করা যায়। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থায় ত্রুটি, ডেথ স্টপের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫ মাইল বেগে ট্রেন চালানো, চালকের প্রশিক্ষণ কম, চালকরা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ায় তাই তাদের জবাবদিহি নেই। ঢাকাসহ সারা দেশে ২৮৩৫ কিলোমিটার রেললাইন রয়েছে। রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ২৪৯৫টি। এরমধ্যে বৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১৪১২টি এবং অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ১০৮২টি। গেটম্যান আছে ২৫৯টি রেলক্রসিংয়ে আর গেটম্যান নেই ২২৩৬টিতে। রেলের ৮০ শতাংশ ইঞ্জিন মেয়াদ উত্তীর্ণ। সারা দেশের রেলপথ চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

আমাদের দেশে সড়কপথে যাতায়াতের চেয়ে রেলপথকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করেন যাত্রীরা। এসব ট্রেনের গতি থাকে ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু তার পরও বিভিন্ন সময় প্রায়শই রেলের বগি লাইনচ্যুত হয়ে যাত্রীদের মৃত্যু ঘটে। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, চালক, সংশ্লিষ্টদের গাফিলতা ও পথচারীদের অসচেতনতার কারণে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। রেলসূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী,

গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসেই রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৩৮ জনের। এর আগের বছর মৃত্যু হয় ৩০৩ জনের। এর আগের বছর মারা যায় ৮১২ জন।

অনাকাক্সিক্ষত বিভিন্ন দুর্ঘটনা এড়াতে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ঝুঁকিপূর্ণ রেলপথ সংস্কারে পূর্বাঞ্চলে রেলক্রসিং পুনর্বাসন ও গেটকিপার নিয়োগে প্রকল্প হাতে নেয় রেল মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৮০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। কিন্তু ধীরগতির কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও শেষ হয়নি সে কাজ। চার বছর আগে এ প্রকল্পের আওতায় ৩২৮টি গুরুত্বপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন কাজ শুরু হয়। প্রকল্পটি ২০১৯ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিল। অথচ নির্ধারিত সময়ের পর আরো পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া ট্রেনের ছাদের ওপর বসে যাত্রী যাতায়াত করেÑ এমন দৃশ্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই বললেই চলে। এ অবস্থা থেকে দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে সময় উপযোগী কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।

এত দীর্ঘ সময় পরও আমাদের ট্রেনের বগি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশে কি বগি তৈরি করার ইন্ডাস্ট্রি স্থাপন করা যায় না! বিষয়গুলোর সঠিক উত্তর কারো জানা নেই। রেললাইনের পাথর চুরি হয়ে যায়, নাটবাল্টু চুরি হয়ে যায়, রেললাইনের সিøপার চুরি হয়ে যায়, সৈয়দপুর কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ওয়ার্কশপ থেকে দিনদুপুরে ট্রাকভর্তি করে দুষ্কৃতকারীরা রেললাইন চুরি করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার খবর পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত তার কোনো বিচার হয়েছে কি না, তা দেশবাসী জানে না। প্রতিটি রেলস্টেশনের সীমানা চিহ্নিত করে রেলওয়ের জায়গা আলাদা করা প্রয়োজন। না হলে রেলওয়ের জায়গা আরো বেদখল হতে থাকবে। কোনো কোনো রেলস্টেশনের আশপাশে থাকা রেলওয়ের ভূমি স্থানীয় প্রভাবশালীরা ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে। তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৫ মাইল গতিতে ট্রেন চালানোর এই অভিনব আইন কোনো দেশে আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। রেলওয়ের নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে আরো আধুনিকীকরণ করা দরকার। অনেক রেলওয়ে পুলিশ সদস্য সীমান্তে চোরাচালানে এবং মাদক পাচারে জড়িত বলে শোনা যায়। তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া খুবই জরুরি। তাছাড়া তাদের আরো জবাবদিহি বাড়ানো দরকার। রেলওয়ের ভূমি বেদখল হওয়ার নেপথ্যে থাকা কারিগরদের খুঁজে বের করার এখনই সময়। রেলওয়ের দখল হওয়া জায়গা ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে উদ্ধার করা জরুর।ি রেলওয়ের জায়গা বেদখলে যারা সহযোগিতা করেছে, সেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনের আওতায় আনা দরকার।

এমনকি রেলওয়ের যত বড় বড় ব্রিজ রয়েছে যেমন ভৈরব, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, বঙ্গবন্ধু সেতুসহ সব ব্রিজের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ দরকার। রেল দুর্ঘটনার পর কিছুদিন বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, তারপর আবার থেমে যায়, কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই রেল লাভজনক। আমাদের দেশে অলাভজনক। এটি যাতে লাভজনক হয়, তার যথাসম্ভব চেষ্টা ও বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close