এস এম মুকুল

  ০৯ অক্টোবর, ২০১৯

গবেষণা

রসায়নেই ভালোবাসা

বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ব্রেনেই ঘটে যতসব কর্মকান্ড। ব্রেনের রসায়নের জন্যই কারো জন্য তৈরি হয় পাগলপ্রায় ভালোবাসা। প্রেমে পড়লে ব্রেনে কী ঘটে, তা নিয়ে কাজ করছেন নিউইয়র্কের রাটজার্স ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ হেলেন ফিশার। তার মতে, মেয়েরা যখনই কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়, অবচেতনভাবেই সে ওই পুরুষকে নিয়ে যৌনচিন্তা করে। তার চিন্তার বেশির ভাগ অংশজুড়েই থাকে ওই পুরুষটি তার সন্তানের পিতা হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন কি না। যদি তার মনে হয়, ওই পুরুষ তার সন্তানের পিতা হওয়ার মতো যোগ্য, তবে সে প্রেমে পড়ার বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলিভাবে। তবে সব নারীই যে এমনটি ভাবে তা নয়; বেশির ভাগ নারী ভাবে, সেটাই ফিশার তার গবেষণায় দেখেছেন। ফিশারের গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, গভীরভাবে প্রেমে পড়লে একজন মানুষের মস্তিষ্কে কী ধরনের পরিবর্তন হয়, সেটি দেখা। তিনি দেখেছেন, যেসব নর-নারী অন্তত কয়েক মাস ধরে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করেছেন, তাদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল টেগমেন্টাল এলাকা ও কডেট নিউক্লিয়াসে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। এমআরআই করে দেখা গেছে, মস্তিষ্কের ওই অংশ অন্য অংশের তুলনায় কিছুটা আলোক উদ্দীপ্ত। এ নিউক্লিয়াসে প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার থাকে। এগুলোর মাধ্যমে অনুভূতির আদান-প্রদান হয়। যথাযথ মাত্রার ডোপামিনে এক ধরনের শক্তি তৈরি হয়। এই শক্তির কারণে প্রেমে পড়া মানুষটি তখন কারো প্রতি বিশেষ মনোযোগ, কারো প্রতি বেশি দুর্বলবোধ বা কাউকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কাজটি করে। ফিশারের মতে, এ কারণে মানুষ যখন প্রথম প্রেমে পড়ে কিংবা গভীরভাবে প্রেমে পড়ে, তখন রাতের পর রাত জেগে থাকতে পারে; অন্য সব কিছুকে বাদ দিয়ে প্রেমের জন্য জীবনবাজি রাখতে পারে; সব কিছুকে গুরুত্বহীন ভেবে শুধু প্রেমের মানুষটির জন্য সামান্য কাজকেও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আর এ কারণে প্রেমে পড়া মানুষটির আচরণ স্বাভাবিক মানুষের কাছে অস্বাভাবিক লাগে।

মানুষকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তার শরীরের ভেতর বিরাজমান যে বস্তুটি সেটি হলো অক্সিটোসিন হরমোন। এক গবেষণায় এমন এক তথ্য আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন বিজ্ঞানীরা। অক্সিটোসিন নামে একটি হরমোনের কারসাজি মাত্র। এই অক্সিটোসিন মানুষকে একে অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। তাতেই মানুষ একে অপরকে ভালোবাসে, সম্মান করে, করুণা দেখায়, সহানুভূতিতে অভিষিক্ত করে। নিউরোসাইকো অ্যানালাইসিস ফাউন্ডেশনের গবেষকদের একজন ড. ভ্যালেন্টিনা কলোন্নেল্লো বলেন, সামাজিক বন্ধন, পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা, সঙ্গী-সঙ্গিনী নির্বাচন, মাতৃত্ব বা পিতৃত্ববোধ প্রকাশের মূলে কাজ করে এই হরমোন। গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে মানুষের মধ্যে আপন-পর বোধ জাগে। এটা এমন এক হরমোন, যা মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে বেঁচে থাকার ব্যাপারে প্রণোদিত করে এবং পারস্পরিক সহমর্মিতা, যোগাযোগ তথা ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে ত্যাগ-তিতিক্ষায়ও উদ্বুদ্ধ করে। সাইকোনিউরোন্ডক্রিনোলজি নামে একটি জার্নালে ছাপা হয়েছে গবেষণাপত্রটি।

এক মাস থেকে দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে প্রেমে পড়া প্রেমিকযুগলের একটি স্টাডিতে ব্রেনের এমআরআই করে গবেষকরা দেখেছেন, প্রেমিকের ছবি দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ব্রেনে উত্তেজনাকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। কেউ নেশা করলে ব্রেনের যে অংশটি উত্তেজিত হয়, প্রেমে পড়লে সেই অংশটিই রেসপন্স করে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। প্রেম পুরো শরীরে নিয়ে আসে এক অভিনব প্রতিক্রিয়া। হার্টের কাজ বেড়ে যায় এবং মানসিকভাবে সে হয়ে পড়ে রোলার কোস্টার। গবেষণায় দেখা গেছে, রোমান্টিক এই অনুভূতি আসে ব্রেন থেকে। নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিস্ট আর্থার অরন গবেষণার ফলাফলে জানান, ‘প্রেম এক অন্যতম মাদকাসক্তি। রোমান্টিকতা এর একটি প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।’ গবেষকরা বলছেন, রোমান্টিকতা মানুষের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতি। মানুষের ব্রেনই এমনভাবে তৈরি যে, সে সব সময়ই প্রিয়জনের ভালোবাসা, তাদের সান্নিধ্য এবং সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করে। ভালোবাসার মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।

লাভ হরমোন বা ভালোবাসা হরমোন নামেও যা পরিচিত। প্রতিটি মানবহৃদয়ে বিশেষ করে তারুণ্যের মানসপটে যার রয়েছে বিলক্ষণ প্রভাব। গবেষণা বলছে, লাভ হরমোন সঙ্গীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার সুযোগ অবারিত করে দিয়ে বহু গামিতার কুপ্রভাব থেকে পুরুষদের সুরক্ষা দিতে পারে। জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত অক্সিটোসিন নারী ও পুরুষের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিয়ন্ত্রণ করে থাকে গবেষণার জন্য ৫৭ জন পুরুষকে বেছে নেওয়া হয়েছিল যাদের নাকের ছিদ্রপথে অক্সিটোসিন বা প্লেসিবো (এটা আদৌ ওষুধজাতীয় কিছু নয়) স্প্রে করা হয়েছিল। অতঃপর তাদের সামনে ২৪ ইঞ্চি দূরত্বে আকর্ষণীয়, উত্তেজক রমণীদের দাঁড় করানো হলো। এসব সুন্দরী রমণী সেখান থেকে ধীরে ধীরে পুরুষদের কাছে এলো এবং আবার দূরে সরে গেল। এখন পুরুষের কাছে জানতে চাওয়া হলো যে, সুন্দরী রমণীরা তাদের থেকে ঠিক কত দূরত্বে থাকাকে তারা নিরাপদ দূরত্ব বলে মনে করেছে এবং কত কাছে এলে তারা অস্বস্তিবোধ করেছে। লাভ হরমোন আসে পিটুইটারি নামক গ্রন্থি থেকে। তবে তা নিঃসৃত হওয়ার পরিমাণ নির্ভর করে নানারকম সামাজিক ও আচরণগত অবস্থার ওপর; যা ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। যেমন কেউ প্রেমে পড়লে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া সন্তান জন্মদানের সময় এবং পরে স্তনপানের সময়ে নারীর দেহে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সন্তান ও মায়ের মধ্যে আত্মিক ও ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close