মোহাম্মদ আবু নোমান

  ০১ আগস্ট, ২০১৯

পর্যালোচনা

ভিআইপি বিলাসী প্রটোকল

আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স কোনটি আর আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে কোন মাত্রার রোগী থাকে, তা যেকোনো ফেরিঘাট কর্তৃপক্ষের অবশ্যই জানতে হবে। এমন তো নয় যে, ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্স চলাচল বিরল ঘটনা। পৃথিবীর সর্বত্রই অ্যাম্বুলেন্স সব সময় গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে থাকে। কোনো রাস্তায় এক সেকেন্ডের জন্যও অ্যাম্বুলেন্স থামতে পারে না। অ্যাম্বুলেন্স চলবেও টপ স্পিডে। অ্যাম্বুলেন্সের গতিরোধ করা, আন্তর্জাতিক আইনে মানবতার বিরুদ্ধের অপরাধ। রোগীর কথা বাদই দিলাম, একজন মানুষের জন্য কেন ফেরির অন্যান্য মানুষ ৩ ঘণ্টা অপেক্ষা করবে? আমজনতার নিয়মিত অধিকারকে ক্ষুণœ করে, ভিআইপিদের ভিআইপি মর্যাদা নেওয়া কি অনুমোদনযোগ্য?

মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ১ নম্বর ফেরিঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করছিল সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত স্কুলছাত্র বহনকারী একটি অ্যাম্বুলেন্স। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফেরিতে ওঠে অ্যাম্বুলেন্সটি। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। মস্তিষ্কে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা যায় ওই স্কুলছাত্র। গত ২৫ জুলাই রাতে এ ঘটনা ঘটে। মারা যাওয়া ওই স্কুলছাত্রের নাম তিতাস ঘোষ। সে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পৌর এলাকার মৃত তাপস ঘোষের ছেলে। কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল তিতাস।

চিন্তা করা যায়, ওই ৩ ঘণ্টা তিতাসের মাসহ আপনজনের কী অবস্থা হয়েছিল? নিহত তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার বোন ফেরির লোকদের পায়ে ধরে মাটিতে পড়ে কেঁদেছে। তবু ওরা ফেরি ছাড়েনি। উল্টো বলেছে, ফেরি ছাড়লে নাকি তাদের চাকরি থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘ফেরির লোকদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে মন্ত্রী আসবে, ভিআইপি আসবে। আমাদের রোগী যে মরে যাচ্ছে, সেদিকে তাদের কোনো নজর নেই। কোনো সহযোগিতা না পেয়ে দিলাম ৯৯৯ কল। কিন্তু সেখানেও কোনো কাজ হলো না।’

ক্ষমতার কাছে মানবিকতার চরম অবক্ষয় পরিলক্ষিত, আজ ভূলুণ্ঠিত মানবিকতা ও মানবতাবোধ। কীভাবে ফেরিচালক বা এর সংশ্লিষ্টরা একজন মুমূর্ষু রোগীসহ আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঘাটে বসে থাকলেন! শুধুই কি চাকরি হারানোর ভয়! ছেলেটা তিলে তিলে মরে যাচ্ছিল, আর ওই ফেরির লোকজন যেন অপেক্ষা করছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের’ জন্য। তাবৎ দুনিয়ার কোনো মানবিক, বিবেকবান মানুষ নিহত তিতাসের দায় ও মৃত্যুর ভার বহন করতে পারবে কি? একালের জমিদারি ব্যবস্থার নিপীড়নে তিতাসের চিকিৎসা ব্যাহত হলো। তিতাস থাকল চিকিৎসাবঞ্চিত।

নানা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা এখন আর ‘সিভিল সারভেন্ট’ নন, সবাই একেকজন জমিদার। জমিদার আর প্রজাদের মধ্যে তফাত থাকবে না? ইতোপূর্বে জনৈক পুলিশ অফিসার বলেছিলেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ।’ সর্বসাধারণের শান্তিতে বাঁচার অধিকার এখন যেমন স্বাভাবিক নয়! তেমনি শান্তিতে মরার অধিকারও যেন নেই! কিছু কিছু ডিসি, এসপি, ওসি আছেন, যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। মনে করেন সর্বেসর্বা। সবাই কিন্তু না। প্রচলিত চর্চার দোহাই দিয়ে মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম যেমন তার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার জন্য ‘ভিআইপি’ প্রটোকলের নির্দেশনা দিয়েছেন। তেমনি দেশে সর্বত্র এ রকম ‘ভিআইপি বিলাসী’ প্রটোকল অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। এসব দায়িত্বশীল কর্মকর্তার ক্ষমতার অপব্যবহার ও গাফিলতির দায় কে নেবেন। এই ভিআইপি যন্ত্রণা দিনে দিনে দেশে প্রকট আকার ধারণ করছে। বিশেষত ঢাকা শহরে ভিআইপিদের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হয়। ভিআইপিদের চলাচলের কারণে প্রায়ই বাসে ৩০ মিনিটের পথ যেতে দুই-আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সরকারি কর্মকর্তারা হচ্ছেন জনগণের সেবক। সংবিধানের ২১ (২) অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য’। আর সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে জনগণ হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। তা হলে সেবক কীভাবে ভিআইপি হতে পারে? অথচ বর্তমানে সেবকরা ভিআইপি হয়ে, তাদের স্থান মালিকের ওপরে ওঠে গেছে! দেশে এমন সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে যে, কর্তাদের সামান্য প্রয়োজনও যেন সাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে দামি। এমন একটা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, উচ্চপদস্থ কেউ কিছু বললেই নিচের সবাই সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে, নিজের জ্ঞান, বুদ্ধি প্রয়োগ না করে, কর্তার কথায় দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাচ্ছেন।

অত্যন্ত সুখজনক ঘটনা! প্রজাতন্ত্রের একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মচারী জনগণকে জিম্মি করে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি আটকিয়ে রাখতে পারেন, তা তদন্ত করে দেখা উচিত। বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশে সরকারি চাকরিজীবীরা জনগণের সেবা করে আর বাংলাদেশে জনগণ সরকারি চাকরিজীবীদের সেবা (ঘুষ দিয়ে) করেন; করেন বললে ভুল বলা হবে, করতে বাধ্য হন। সেটা এভাবে জীবন দিয়ে হলেও।

মাদারীপুরের ডিসি বলেছেন, তিনি অ্যাম্বুলেন্সের কথা জানতেন না। ফেরিঘাটের ম্যানেজার বলেন, ‘ডিসি স্যার ফোন দিয়ে রাতে জানান, ভিআইপি যাবেন। তবে আমি তখন ঘাটে ছিলাম না। আমাদের স্টাফকে বলে দিই ভিআইপি আসার কথা। পরে সেখানে কী হয়, তা আমার জানা নেই।’ ডিসি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যুগ্ম সচিবকে ভিআইপি বলা যায়। এ ধরনের কর্মকর্তারা এই নৌপথে এলে তাদের বিশেষভাবে গুরুত্ব আগে থেকেই দেওয়া হচ্ছে।’ এভাবে দায় এড়ানোর কথাবার্তা ও ঘটনায় একটি প্রশাসনিক শূন্যতা নয় কি? অন্যদিকে গাফিলতির অভিযোগ অস্বীকার করে ঘাটে কর্তব্যরত বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যদের দাবি, তাদের কাছে রোগীর স্বজনরা রোগীর অবস্থা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়। অ্যাম্বুলেন্স ফেরিতে লোড করে ১০ মিনিটের মধ্যেই ঘাট থেকে কুমিল্লা ফেরিটি শিমুলিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। তাদের এ মন্তব্যে মিথ্যাচার আছে কি না, দেখতে হবে? একজন ডিসির বুঝতে হবে, তিনি যখন একটি ‘অস্বাভাবিক (যান্ত্রিক) আদেশ’ করেন, তার সে আদেশের ফল কী হতে পারে। ফেরিঘাটে অপেক্ষমাণ কোনো আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সকে তিন ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা অবশ্যই বে-আইনি। এজন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সরকারের কাছে তিতাস পরিবারের দুই ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর তার চিকিৎসা নিতে বাধা তৈরি করার কারণে।

তিতাস ঘোষের স্বজনরা জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিতাস গুরুতর আহত হয়। প্রথমে তাকে খুলনার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর কথা বলেন চিকিৎসক। তাই চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে অর্ধ লাখ টাকায় ভাড়া করা হয় আইসিইউসংবলিত অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে এসে থামে রাত ৮টার দিকে। ঘাটে ফেরি পারাপারের জন্য তারা ঘাট কর্তৃপক্ষ ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। তিন ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকার পর রাত পৌনে ১১টার দিকে সাদা রঙের নোয়া মাইক্রোবাসটি ফেরিতে ওঠার পরে ছাড়া হয় ফেরি। ফেরিটি ছাড়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই মাঝনদীতে মারা যায় তিতাস।

তিতাসের বড় বোন তন্নীসা ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের জীবন কেড়ে নিল ভিআইপি। এ দেশে জীবনের দাম বেশি না, ভিআইপিদের দাম বেশি?’ তিতাসের মা সোনামণি ঘোষ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, ‘ওরা আমার পোলারে মেরে ফেলছে। আমি ফেরিওয়ালাগো পায় ধরছি, তবু ওরা ফেরি ছাড়ে নাই। ফেরি ঠিকমতোন গেলে হয়তো পোলাডা বাঁইচা যাইতো।’

ভিআইপিদের অযাচিত সুবিধা দিতে গিয়ে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুবরণ করতে হবে এ ধরনের ঘটনা কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক দেশের চর্চা হতে পারে না। সংবিধান যেখানে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছে, সেখানে কোনো বিশেষ সুবিধা প্রদানের এ বৈষম্যমূলক, অসাংবিধানিক ও ‘ভিআইপি সংস্কৃতির’ অপব্যবহার প্রতিহতে ব্যর্থতা লজ্জাজনক। এর প্রতিকারের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের হস্তক্ষেপ জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close