মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

  ৩১ মে, ২০১৮

নিবন্ধ

মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে ইসলাম

ইসলামে সব ধরনের অপব্যয় অবশ্যই বর্জনীয়। মাদকাসক্তি মারাত্মক অপব্যয়। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তির জন্য দৈনিক প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়। মাদক গ্রহণ ও সেবনে অনেক ধনসম্পদ অপব্যয় ও অপচয় হয়। এই অপব্যয় পরিবার ও সমাজের জন্য অপরিসীম দুর্ভোগ নিয়ে আসে। অনর্থক অপব্যয় জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ তাআলা অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই মর্মে কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ২৭)।

মাদকাসক্তি মানে মাদকদ্রব্যের দ্বারা আসক্তি বা নেশা সৃষ্টি হওয়া। যেসব খাদ্য, পানীয় বা বস্তু সুস্থ মস্তিষ্কের বিকৃতি ঘটায়, জ্ঞান-বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি লোপ করে দেয় অথবা বোধশক্তির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে সেগুলো মাদকদ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রিয়নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, প্রত্যেক নেশাদ্রব্যই মদ, আর যাবতীয় মদই হারাম। (মুসলিম ও মেশকাত, হাদিস : ৩৬৩৮) মাদকাসক্ত তার মাদকের ব্যয় সংকুলানের জন্য নানা রকম দুর্নীতি অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। নিজের পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে সমাজের আর দশজনের টাকা-পয়সাও লুটে নিয়ে সমাজ জীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। এভাবে মাদকাসক্ত মানুষ নিকৃষ্টতর কর্মকা-ে ও পাপাচারে বাধ্য হয়। মাদকদ্রব্য ব্যবহারে মানুষ চিত্ত বিভ্রম, অস্থির, উচ্ছৃঙ্খল ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় তথা ব্যভিচার ও নরহত্যার মতো ন্যক্কারজনক অপরাধগুলোর অধিকাংশই বিষধর মাদকাসক্তির ভয়াবহ পরিণাম। সমাজের বেশির ভাগ অপরাধের জন্য মুখ্যভাবে দায়ী এই মাদকতা। এ জন্য রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মদ পান কোরো না। কেননা তা সব অপকর্মের চাবিকাঠি।’ (ইবনে মাজাহ : ৩৩৭১)। বাস, ট্রাক, ট্যাক্সি প্রভৃতি যানবাহন সংঘর্ষ ও সড়ক দুর্ঘটনা বেশির ভাগ মাদকাসক্ত চালকের কারণেই ঘটে থাকে।

এতদ্ব্যতীত দেশের আশা-ভরসা ও মূল্যবান সম্পদ তথা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যুবশক্তিকে ধ্বংস করার এক মোক্ষম হাতিয়ার এ মাদকাসক্তি। যেসব নর-নারী ও শিশুরা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে না, তাদের নিঃশ্বাসের সঙ্গে মদের দুর্গন্ধ পেটের মধ্যে চলে গিয়ে ক্ষতি হয়। তা ছাড়া অনেক লোক মাদক সেবনকারীর সঙ্গে ওঠাবসার দ্বারা মাদক গ্রহণ করতে পারে, ফলে পরিবেশ দূষিত হয়। উপরন্তু মাদকাসক্তি মানুষকে ব্যবহারিক জীবনে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ তথা কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ মহান রাব্বুল আলামিনের বিধিবদ্ধ দৈহিক ও আত্মিক ইবাদত থেকে দূরে রাখে এবং পাপাচারে লিপ্ত করে। এতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন এবং পরিণামে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখতে চায়, তবুও কি তোমরা তা থেকে নিবৃত হবে না।’ (সুরা মায়িদা : ৯১)।

মাদকাসক্তি সমাজ দেশ ও জাতিকে বিধ্বস্তকারী ব্যাধি। তাই সমাজ জীবনে এহেন ঘৃণ্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার রোধ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে যারা মাদকদ্রব্য প্রস্তুত, এর প্রচলন ও সরবরাহ কাজে জড়িত, তাদের দেশ ও জাতির স্বার্থে এ ঘৃণ্য কাজ বর্জন করা উচিত। তারা সমাজকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খল করার জন্য নিজেদের আর্থিক ফায়দা লুটার পরিবর্তে মাদক-সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবে। পরিবারের প্রধান দায়িত্বে নিয়োজিত মা-বাবা, ভাই-বোন ও অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের মাদকদ্রব্যের ভয়াবহতা সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত করবেন এবং তাদের মধ্যে কু-অভ্যাস যেন কোনো মতেই গড়ে উঠতে না পারে, এ ব্যাপারে সদা-সতর্ক থাকবেন। তারা যাতে অসৎ ও দুশ্চরিত্র বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথির সঙ্গে মেলামেশা না করতে পারে, এদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন এবং ইসলামের আলোকে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করবেন। শিক্ষকসমাজ তাদের সুন্দর চরিত্র, আচার-আচরণ, আদেশ-উপদেশ দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিধিবিধান শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের নেশা ও মাদকমুক্ত রাখতে অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।

মসজিদের ইমাম সাহেব যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বিশেষ করে জুমাবার খুতবার ভাষণে মাদকদ্রব্যের ক্ষতির দিকগুলো উপস্থাপন করেন, তাহলে সমবেত মুসল্লিয়ানে কেরাম মাদক গ্রহণ না করার ব্যাপারে সজাগ হয়ে যাবেন এবং তাদের সন্তানদেরও মাদক গ্রহণে নিরুৎসাহিত করবেন। সমাজের ধর্মীয় প-িত-বিশেষজ্ঞ তথা আলেম-উলামা বিভিন্ন মাহফিলে ওয়াজ ও নসিহত ও উপদেশ দানের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে মাদকদ্রব্যের কুফলসমূহ বর্ণনা করবেন। সরকার মাদকের প্রতিকার ও প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কঠোর আইন প্রণয়ন করবে এবং তা প্রয়োগ করবে। যারা মাদক আমদানি ও পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করবে, তাহলে সমাজ মাদকমুক্ত হতে পারবে। তবে একতরফা নয়, সবার জন্য সমাবভাবে। উপরন্তু সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সব শ্রেণির লোক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মাদকদ্রব্যের প্রসার রোধের দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালান, যারা কোনো অবস্থাতেই সমাজের কাউকে মাদকদ্রব্য প্রস্তুত, বেচাকেনা এবং সেবিন করতে দেবেন না, তাহলে সমাজ থেকে মাদকদ্রব্য ব্যবহার নির্মূল হবে।

বস্তুত, নেশার বদ-অভ্যাস ত্যাগ করা যে অত্যন্ত কঠিন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তদুপরি আমরা সমবেত কণ্ঠে বলতে পারি, মাদকদ্রব্য কোনো অবস্থাতেই গ্রহণ নয়, বর্জন করতে হবে। এটি ধর্মীয়, দৈহিক, মানসিক, নৈতিক ও সামাজিক বিনাশ করে, তাই এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং স্বোচ্চার হতে হবে। সর্বোপরি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের বিধিবিধান ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে ইসলামের আলোকে মানবজীবন পরিচালনার মাধ্যমে সমাজ থেকে মাদকদ্রব্য বিদূরিত হবে এবং শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে, এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist