হামিদুর রহমান, বড়লেখা (মৌলভীবাজার)

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

বর্নির ধুছনির দই

মৌলভীবাজারের বড়লেখা

ভিন্ন স্বাদের দই, নাম ‘বর্নির ধুছনির দই’। এ দইয়ের আঁতুড়ঘর মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বর্নি ইউনিয়নে। দইয়ের নামের সঙ্গে তাই ‘বর্নি’ যুক্ত হয়েছে। এটি তৈরি করা হয় গরু ও মহিষের দুধে। গোলগাল পাত্রটিও ভিন্ন ধাঁচের, বাঁশের তৈরি ঝুড়ি, যা ‘ধুছনি’ নামে পরিচিত।

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার বর্নি ইউনিয়নে বর্নির ধুছনির দই স্বাদে অতুলনীয়। এই বিশেষ দই তৈরি হয় হাকালুকি হাওর পাড়ের গরু ও মহিষের টাটকা দুধ দিয়ে। প্রচার না থাকায় এই বর্নি ধুছনির দইয়ের স্বাদ থেকে অনেক বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে দিন দিন এই দইয়ের চাহিদা বাড়ছে বলে জানান দইয়ের কারিগর গৌরাঙ্গ দাস (ঝাড়ন)।

গত বৃহস্পতিবার পারিবারিক একটি কাজে মৌলভীবাজারের বড়লেখায় যান এই প্রতিবেদক। তার সঙ্গে ছিলেন চাচা আবদুল ওয়াহিদ ও মামা ডি এম নজরুল ইসলাম। স্থানীয় সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক তপন কুমার দাস বড়লেখা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী বর্নি ইউনিয়নের নিহারী ফড়িঙ্গা গ্রামের গৌরাঙ্গ দাসের বাড়িতে তাদের নিয়ে যান।

গৌরাঙ্গ দাসের বাড়িতে দেখা গেছে, বাঁশ-বেতের তৈরি ছোট ঝুড়ি, যা ধুছনি নামে পরিচিত। সেই ধুছনির গায়ে ক্ষীরের মতো ময়দার প্রলেপ মাখিয়ে ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছেন এক নারী। তারপর সেই ধুছনিতে মহিষের দুধ ঢেলে দই পাতা হচ্ছে। গৌরাঙ্গ দাস বলেন, ‘আগে বাপ-দাদা বানাইছে (তৈরি করেছেন)। এটা অরিজিনাল দুধের দই। অন্য কিছুই মিশাই না। হাওর এলাকায় ভইষের (মহিষের) দুধ দিয়ে আমরা নিজের হাতে বানাই। কাইত (কাত) করলেও পড়ে না। গরুর দুধ দিয়েও করি। যার চাহিদা যেটা, ওটা নেয়।’

তিনি বলেন, এটা তাদের পারিবারিক ব্যবসা। তাদের গ্রামটি হাকালুকি হাওরের পারে। হাওরে ঘাস, শালুকসহ নানা জলজ উদ্ভিদের প্রাচুর্য থাকায় অনেকেই গরু-মহিষ পালন করেন। এখনো হাওর পারের এলাকাটিতে গরু-মহিষের নির্ভেজাল দুধ পাওয়া যায়। তারাও বাবা-দাদার পেশাটি ধরে আছেন। পাত্রের পরিচয় ও স্বাদের ভিন্নতায় এই দইয়ের আলাদা কদর রয়েছে। পাত্রটি বানানো হয় বাঁশ-বেত দিয়ে। এরও আলাদা কারিগর আছেন, তারা চাহিদামতো বানিয়ে দেন। যে বাঁশ-বেতের তৈরি পাত্রটিতে এই দই বসানো হয়, এটির স্থানীয় নাম ‘ধুছনি’। ধুছনিতে পাতা হয় বলে এর পরিচিতিও হয়েছে ‘ধুছনির দই’ নামে।

এই ধুছনি তৈরি করেন বর্নির নিহারী-নওয়াগ্রামের বাসন্তি রানী দাস। তিনি বলেন, ‘আমি ও আমার বিধবা পুত্রবধূ (সবিতা দাস) ধুছনি বানাই। বাপের (বাবার) বাড়ি স্কুলে পড়ার সময় বেত-বাঁশের কিছু কাজ শিখেছিলাম। এখন এটা দিয়াই সংসার চালাই।’ তিনি বলেন, এলাকায় বাঁশ-বেতের কাজ দু-একটি পরিবার করে থাকে, তবে ওজন-মাপ ঠিক রেখে এই ধুছনি তারাই বানান। একটি ধুছনির দাম পড়ে ৪০ টাকা। এ ছাড়া ফুলের সাজি, ডালাসহ বাঁশ-বেতের অন্য তৈজসপত্রও তৈরি করেন। এই বাঁশ-বেতের কাজ দিয়েই ১১ সদস্যের পরিবার চলে।

জানা গেছে, দুই কেজি ও পাঁচ কেজি ওজনের ধুছনিতে তারা দই পাতেন (বসান)। এক কেজি দইয়ের দাম ৩৫০ টাকা। প্রতিদিন কিছু না কিছু দইয়ের অর্ডার থাকে। ক্রেতার বাড়িতে দই পৌঁছে দেওয়া হয়। কখনো ক্রেতা এসে তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। তবে কোনো সময় দইয়ের চাহিদা না থাকলে এ দুধ দিয়ে ছানা তৈরি করে মিষ্টির দোকানে বিক্রি করেন। এখন প্রতিনিয়তই দইয়ের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে ঘুরতে আসা লোকজন হাকালুকির পাড়ের ছোট্ট গ্রামটিতে দই খেতে আসেন।

বিয়ে বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এক মণ বা তারও বেশি চাহিদা থাকে। তখন বাইরে থেকে দুধ সংগ্রহ করা হয়। হাকালুকি হাওর পারে ‘আবাদি’ বলে একটি বাজারে সকালবেলা দুধের হাট বসে। স্থানীয় গরু-মহিষের মালিক সেই হাটে টাটকা দুধ নিয়ে আসেন। সেই হাট থেকে তারা দুধ কিনেন। বড়লেখা ছাড়াও মৌলভীবাজারের জুড়ী, সিলেট ও সিলেটের গোলাপগঞ্জে এই দইয়ের চাহিদা আছে। সেসব এলাকা থেকে ক্রেতারা দই নিতে আসেন।

বড়লেখার অজমীর গ্রামের সজল দে ও মান্না দে বলেন, আমরা বহু দিন ধরে ধুছনীর দই খেয়ে আসছি। মহিষের দুধের এ দইয়ের স্বাদ চমৎকার। আমাদের আত্মীয়দের কাছে ধুছনির দইয়ের চাহিদা ব্যাপক। তারাও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই বিশেষ ধুছনি দই নিয়ে থাকেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close