রাজু খান, ঝালকাঠি

  ০৫ নভেম্বর, ২০১৮

আওয়ামী লীগ মাঠে, বিএনপি ঢাকায় লবিংয়ে ব্যস্ত

আমুর বিপরীতে বিএনপির একডজন প্রার্থী

ঝালকাঠি-২ আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী জ্যেষ্ঠ নেতা শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত। জেলার নেতাকর্মীরাও তাকে ঘিরে একত্র রয়েছেন। তার বিপরীতে মনোনয়ন পেতে বিএনপির একডজন নেতা কেন্দ্রে লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।

ঝালকাঠি সদর এবং নলছিটি উপজেলার দুইটি পৌরসভা ও ২০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনের সব খানেই এখন নির্বাচনী উত্তেজনা। মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। একদিকে যেমন নিজের সমর্থন আদায়ের জন্য নেতাকর্মীদের দ্বারে দ্বারে ছুটছেন, তেমনি মনোনয়ন পেতে লবিং শুরু করেছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে।

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বরিশাল বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু, জেলা বিএনপির সম্পাদক সাবেক ছাত্রদল নেতা মনিরুল ইসলাম নূপুর, সিনিয়র সহসভাপতি মিঞা আহমেদ কিবরিয়া, পাকিস্তান সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার আক্তার উদ্দিন আহমেদের মেয়ে ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য জেবা আমিন খান, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা অ্যাডভোকেট রফিক হাওলাদার, কেন্দ্রীয় যুবদলের সহ-সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা যুবদল সভাপতি এম কামরুল ইসলাম, বিএনপির কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম। এছাড়া বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে জেলা জামায়াতের আমির অ্যাডভোকেট হাফিজুর রহমান ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক শেখ জামাল উদ্দিন ২০ দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।

এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম দলীয় হাতপাখা প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। অপরদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ জাতীয় পার্টির (এরশাদ) চেয়ারম্যান উপদেষ্টা এম এ কুদ্দুস খান, জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন আনু এবং জাসদ (ইনু) জেলা সভাপতি সুকমল ওঝা দোলনও জোটের কাছে মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে। এছাড়াও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি, রব) জেলা সম্পাদক সমীরণ হালদার সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে প্রতিদিনের সংবাদকে জানিয়েছেন তিনি।

আওয়ামী লীগ

ঝালকাঠি সদর এবং নলছিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা যেকোন সময়ের তুলনায় ভালো। জেলা এবং উপজেলা নেই কোনো গ্রুপিং। দুই উপজেলাতেই দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আমুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। তবে ১৯৯৬ সালের পূর্বে নলছিটিতে ওয়ার্ডে কমিটি করার মতো লোক পাওয়া যেত না দলের। এখন প্রতি ওয়ার্ডে কমিটি করেছেন আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর আমু টেকনোক্র্যাট কোটায় খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তখন থেকেই এই এলাকায় আওয়ামী লীগ সংগঠিত হতে পারে। ২০০০ সালে এই আসনের এমপি জাতীয় পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টোর আকস্মিক মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে আমির হোসেন আমু এমপি নির্বাচিত হয়ে উন্নয়নের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। ঝালকাঠি সদর আসনে আমির হোসেন আমুই প্রথম পূর্ণমন্ত্রী। তার পক্ষে খোদ এরশাদের সমর্থন আছে বলে প্রচারিত। ফলে এ আসনে নৌকা প্রতীকে ভোটের পাল্লাও ভারি হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে আ.লীগের একক প্রার্থী হিসেবে বর্তমান এমপি আমির হোসেন আমুর নাম জেলা কমিটিতে অনুমোদন করে কেন্দ্রে পাঠানো হবে। এ আসনে দলের মনোনয়ন পেতে অন্য কোনো আগ্রহী ব্যক্তির নাম এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। ফলে তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীও নেই।

জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক অ্যাডভোকেট খান সাইফুল্লাহ পনির বলেন, সাংগঠনিকভাবে এখানকার আওয়ামী লীগ একটি শক্তিশালী সংগঠন। উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত দুই টার্মে ঝালকাঠি জেলায় হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমরা ঝালকাঠির দুইটি আসন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিতে পারব। নলছিটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র তছলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, উন্নয়নের ধারা অব্যহত রাখতে নলছিটির মানুষ আমির হোসেন আমুর সঙ্গে থাকবে।

বিএনপি

ঝালকাঠি-২ আসনে আওয়ামী লীগে একক প্রার্থী থাকলেও বিএনপির চিত্র উল্টো। এখানে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ডজন খানেক। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে সবাই আবার বিএনপি বা অঙ্গ সংগঠনের সদস্য নয়। ঝালকাঠি এবং নলছিটিতে বিএনপির ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল দলটির পিছু ছাড়ছে না জন্ম থেকে। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট আবদুল বারেককে পাস কাটিয়ে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় মুসলিম লীগ থেকে সদ্য দলে আসা অ্যাডভোকেট আবদুর রবকে। ১৯৮০ সালের শেষ দিকে ঝালকাঠি ডাকবাংলোতে বিএনপির জেলা কমিটি গঠন নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত মেজর শাহজাহান ওমর এবং ঝালকাঠি পৌরসভার ওই সময়ের চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল। পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে দলের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সিদ্দিক হোসেনকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া ওই সময়ে ঝালকাঠি সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টি নেতা ব্যবসায়ী গাজী আজিজ ফেরদৌসকে। আবার ২০০১ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় নির্বাচনের কয়েক দিন আগে জাতীয় পার্টি থেকে দলে আসা এ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য জুলফিকার আলী ভুট্টোর স্ত্রী ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টোকে। বর্তমানে ঝালকাঠি বিএনপিতে কোন্দল রয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে ঐক্য গড়ার চেষ্টা করলেও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিরোধ টিকিয়ে রাখছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ সংকট শুধু একাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে নয়। এর আগে যতগুলো সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে সব নির্বাচনে হঠাৎ দলে আসাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনে এ আসনে যারা মনোনয়ন চাইতে পারেন এবং কেন্দ্রে তদবির করছেন বলে নাম শোনা যাচ্ছে তাদের মধ্যে অন্যতম ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মিয়া আহমেদ কিবরিয়া। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে মিঞা আহমেদ কিবরিয়া দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন এবং খরচ বহন করছেন। পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হয়েছেন, গাড়ি পোড়ানোসহ বেশ কয়েকটি মামলায় আসামি হয়ে জেলে যেতে হয়েছিল তাকে। এখন দিতে হয় হাজিরা।

জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি মিঞা আহমেদ কিবরিয়া বলেন, নির্বাচনের জন্য আমরা সব সময় তৈরি আছি। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সভা করে আমরা নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা মামলা হামলা ভয় করি না। বর্তমান সরকারের আমলে আমি যে নির্যাতনের শিকার হয়েছি, আশা করি দল আমাকে নির্বাচনের সময় পুরস্কৃত করবে।

জেলা বিএনপির সম্পাদক মনিরুল ইসলাম নুপুর বলেন, যারা ঢাকায় থেকে আগামী নির্বাচনে বসন্তের কোকিলের মতো এসে মনোনয়ন হাসিল করতে চায়, নেতাকর্মীদের সঙ্গে যাদের কোনো যোগাযোগ নেই। আন্দোলন সংগ্রামে কোনো ভূমিকা নেই। তারাই দলের মধ্যে কোন্দল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এদের প্রতিহত করার জন্য আমরা জেলা বিএনপি তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করব। তিনি আরো বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সাবেক সংসদ সদস্য ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো আমাদের অথৈ সাগরে ফেলে পালিয়ে গেছেন। তিনি এখন আর বিএনপির সঙ্গে নেই তার বিএনপির নমিনেশন চাওয়ার নৈতিক অধিকার নেই। তাকে নমিনেশন দিলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করবে। কিবরিয়ার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও দল মনোনয়ন যাকে দেবে তাকে বিজয়ী করতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি করেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুল হক নান্নু বলেন, ওয়ান ইলেভেনেরে সময় অনেকে পালিয়ে গেলেও আমি তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে ছিলাম। সে কারণে দেশনেত্রী আমাকে মূল্যায়ন করে কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা দিয়েছেন। যারা দলের মনোনয়ন চাইছেন তারা সাংগঠনিক ও তৃণমূলে জনপ্রিয় কেউ নয়। দলের ত্যাগী নেতাকে মনোনয়ন দিলে এসব গ্রুপিং আজ থাকত না। যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী আমির হোসেন আমুকে পরাজিত করে আসনটি ফিরে পাওয়া যাবে।

জাতীয় পার্টির প্রার্থী এম এ কুদ্দুস খান বলেন, আমার নেতৃত্বে ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি উপজেলার দুইটি পৌরসভা ও ২০টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরশাদের ঘাঁটি হিসেবে ঝালকাঠি-২ আসন পরিচিত। আগের চেয়ে এখানে জাতীয় পার্টি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে দলের অথবা জোটের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দিলে অবশ্যই নির্বাচিত হতে পারব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close