মো. শাহ আলম, খুলনা

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

খুলনার নদ-নদী ও খালে অস্বাভাবিক লবণাক্ততা

খুলনা অঞ্চলের নদী খালের লবণাক্ততা এতটাই বেড়েছে- এ পানি কোনো কাজে আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বহু আগেই তা সেচের উপযোগিতা হারিয়েছে। সাধারণত পানিতে লবণাক্তের পরিমাণ ৫ ডিএস বা মিটারের ওপরে গেলে এ পানি আর সেচকাজে ব্যবহার করা যায় না। খুলনার কয়রা খালের পানিতে গত এপ্রিলে লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের (মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট) সর্বশেষ জরিপে ৪২.৯ ডিএস বা মিটার পাওয়া যায়। সমুদ্রের পানিতে এর পরিমাণ থাকে ৫০ ডিএস বা মিটারের কাছাকাছি থাকায় কয়রা খালের পানি কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। ওইসময় রূপসা নদীতে লবণাক্ততা ছিল ২৩.৭ ডিএস বা মিটার, যা ২০২৩ সালের মে মাসে ছিল ১৮.৫৬ ডিএস বা মিটার। পাইকগাছা শিবসা নদীতে এপ্রিলে লবণাক্ততা ছিল ৩৫.৯ ডিএস বা মিটার, যা আগের বছরের মে মাসে ছিল ২৬.৬৪ ডিএস বা মিটার। এছাড়া পশুর নদী মোংলায় ৩৩.৩ ডিএস বা মিটার ও দড়াটানা নদী বাগেরহাটে লবণাক্ততা ছিল ২২.৮ ডিএস বা মিটার।

একইভাবে গত মার্চে ডুমুরিয়ার গুটুদিয়ায় মাটিতে লবণাক্ততা ছিল ৪.৬ ডিএস বা মিটার, ফুলতলা বটিয়াঘাটায় ৪.১ ডিএস বা মিটার, মোংলা উপজেলার দিগরাজে গড়ে ৯.১, পাইকগাছার শিববাড়ী এলাকার মাটিতে ১৪ ডিএস বা মিটার। শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের নদীগুলোর পানি ব্যবহার উপযোগী না থাকায় প্রতি বছরই চাষের জমি হারাচ্ছেন কৃষক। বিশে¯œষকরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উজানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় নদনদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রতি বছরই লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলেও লবণাক্ততা বাড়ছে। এতে শুষ্ক মৌসুমে খুলনা, সাতÍগীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় ফসল উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এছাড়া লবণাক্ততার কারণে হাতে পায়ে সাদাটে ঘা, গর্ভকালীন নারীর ভ্রূণ নষ্ট হওয়া, জরায়ু রোগে আক্রাšত্মসহ নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে।

খুলনা লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশে লবণাক্ত জমি বেড়েছে প্রায় ২৬.৭ শতাংশ। ২০২২ সালে সর্বশেষ দেশের উপকূলীয় ১৮টি জেলায় চালানো জরিপ অনুযায়ী, ২৮ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে লবণাক্ত জমির পরিমাণ প্রায় ১১ লাখ হেক্টর। এর আগে ২০০০ সালের জরিপে উপকূলের লবণাক্ত জমি ছিল ১০ লাখ ২০ হাজার ৭০০ ও ২০০৯ সালের জরিপে ছিল ১০ লাখ ৫৬ হাজার ২৬০ হেক্টর। জানা যায়, চলতি মৌসুমে অতিরিক্ত খরা ও লবণাক্ততার কারণে খুলনার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছায় সবজি চাষ ব্যাহত হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে গাছ শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট প্রতি মাসে খুলনা, সাতÍগীরা ও বাগেরহাট জেলার ৯টি উপজেলার ১৭টি পয়েন্ট থেকে মাটি ও ১৩টি নদীর পানিতে লবণাক্ততা পরীÍগা করে। মাটি ও পানির লবণাক্ততা পরিমাপ প্রতিবেদন বিশে¯œষণ করে দেখা গেছে, ফেব্র¤œয়ারি থেকে নদীর পানিতে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে, মে মাসে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। অন্যদিকে মাটিতে লবণাক্ততা সবচেয়ে বেশি থাকে এপ্রিলে।

লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র খুলনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস জানান, লবণাক্ততার সহনশীল মাত্রা প্রতি মিটারে পানির জন্য ০.৭৫ ডেসি সিমেন (ডিএস) ও মাটির জন্য ২ ডিএস। মাটিতে লবণক্ততা ৪ ডিএস বা মিটারের বেশি থাকলে ফলন কমে, ৪ থেকে ৮ ডিএস বা মিটার পর্যšত্ম লবণ থাকলে ফলন আরো কমে যায়। পরিবেশবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উত্তরণ ও পানি কমিটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ষাটের দশকে উপকূলে বেড়িবাঁধ নির্মাণের ফলে ১৩টি পোল্ডারের মধ্যে ১০৯টি নদী অবর¤œদ্ধ হয়। সেই নদী এখন পানি নিষ্কাশনের খালে পরিণত হয়েছে। পোল্ডারের বাইরের ২০টি উন্মুক্ত নদীর মধ্যে ৯টি নদী ভরাট হয়ে যায়। আরো ১১টি নদীর উজান অংশ মৃত। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার শাখা নদীগুলোর অনিশ্চিত প্রবাহের কারণে দÍিগণ-পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততার উত্তর অঞ্চলমুখী বি¯ত্মার লাভ করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতার পাশাপাশি প্রতি বছরে খুলনায় ভূমি অবনমন হচ্ছে ৫.১ মিলিমিটার ও সুন্দরবনে ৪.১ মিলিমিটার। জীবনযাপনে সংকটে বাস্তুভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে।

এদিকে মাটি ও পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চল কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। উপকূলীয় ৯টি উপজেলার ৫২টি ইউনিয়নকে বেশি লবণাক্ত চিহ্নিত করে সেখানে বৃষ্টির পানি সংরÍগণ, ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পুকুর খনন ও পিএসএফ নির্মাণ এবং যে স্থানে নলকূপে মিষ্টি পানি পাওয়া যায় সেখানে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) খুলনার বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, দÍিগণ-পশ্চিমাঞ্চলে নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় সমুদ্রের লবণ পানি উপকূলকে গ্রাস করছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতার কারণে বেড়ে যাওয়া সমুদ্রের পানির উচ্চতা ও ভূগর্ভস্থ পানির উচ্চতা তারতম্যের কারণে লবণাক্ততার ঊর্ধ্বমুখী উপকূল থেকে অভ্যšত্মরীণ ভূখণ্ডের দিকে প্রবাহের ঘটনা ঘটছে। এতে কৃষিকাজের জন্য গুর¤œত্বপূর্ণ ভূগর্ভস্থ জলাধারে (রেইনওয়াটার লেন্স) লবণাক্ততা অনুপ্রবেশে ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলাধার হতে লবণাক্ততার ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহের ফলে মিঠাপানির পরিমাণ আরো হ্রাস পেতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলে নোনাপানিতে চিংড়ি চাষ, পলি পড়ে নদী ভরাট হওয়া ও বেড়িবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের নোনাপানিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়ছে। এÍেগত্রে পানি কমিটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ থেকে ১৫ বছর নদীবÍেগ পলি জমা হওয়ার কারণে নদী তার নিষ্কাশন Íগমতা হারিয়ে ফেলে এবং দ্র¤œত মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এতে লবণাক্ততা কমাতে উজান থেকে নদীর পানি প্রবাহ ঠিক রাখতে জোর দেওয়া হয়। এছাড়া নদী রÍগায় দÍিগণ-পশ্চিমাঞ্চলে আঞ্চলিক বোর্ড গঠন, পোল্ডারের মধ্যে আবদ্ধ নদী মুক্ত করা, পদ্মা প্রবাহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও মাল্টি স্টেকহোল্ডার ফোরাম গঠনে সুপারিশ করা হয়। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ এ বলা হয়, লবণাক্ততা রোধে শুষ্ক মৌসুমে নদীর নিষ্কাশন Íগমতা ও মিঠা পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে পদÍেগপ নিতে হবে। আঞ্চলিক নদী পুনর¤œজ্জীবিত ও খাল খনন করতে হবে যাতে লবণাক্ততার মাত্রা ১০ পিপিটিতে পৌঁছানো পর্যšত্ম কার্যকারিতা বজায় থাকে। ভূগর্ভস্থ জলাধার হতে পানি উত্তোলন ব্যবস্থার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হবে। তবে এলাকাভিত্তিক সমস্যার সমাধান হলেও এÍেগত্রে সম্পূর্ণ উপকূলীয় অঞ্চলের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close