প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

বিবিসির প্রতিবেদন

ফ্রি ভিসায় বিদেশযাত্রা, শূন্য হাতে ফিরছেন লাখো শ্রমিক

ভাগ্য ঘোরানোর আশা নিয়ে এক বছর আগে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম। ধারদেনা করে তার খরচ হয়েছিল প্রায় ৫ লাখ টাকা। কিন্তু যে কাজের কথা বলে তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল রিক্রুটিং এজেন্সি, বিদেশে গিয়ে অন্য কাজ ধরিয়ে দেওয়া হয় সেলিমকে।

সেলিম বলেন, শুরুতেই দেওয়া হয় কনস্ট্রাকশনে পাইলিংয়ে হ্যামারিংয়ের কাজ। আমি এটা কোনোদিন করিনি। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপত। একপর্যায়ে দুর্ঘটনায় পড়ে যাই, ঠিকমতো চিকিৎসাও পাইনি। আমি ছুটি নিয়ে দেশে ফিরে আসতে চাইলেও কোম্পানি রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিয়েই আসি। তাতে শেষ দুই মাসের বেতনও পাইনি। খালি হাতে দেশে ফিরে এখন ঋণ পরিশোধের চাপে দিশাহারা আমি। প্রবাসে গিয়ে সেলিমের যে অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের অনেকেই তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। দেশটি থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে পরে নিঃস্ব হয়ে ফিরছেন খালি হাতে। অথচ শ্রমিক পাঠানো নিয়ে যত আলোচনা, শ্রমিকদের এরকম শূন্য হাতে ফিরে আসা নিয়ে ততটা আলোচনা নেই বাংলাদেশে।

‘ফ্রি ভিসা’র গল্প : খাদেমুল ইসলাম (ছদ্মনাম) কয়েক মাস আগে শ্রমিক হিসেবে যান কুয়েতে। তবে তার ভিসা কোনো রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে আসেনি। তাকে ভিসা জোগাড় করে দেন তারই এলাকার একজন কাতার প্রবাসী। যেটিকে বলা হচ্ছে ‘ফ্রি ভিসা’। অর্থাৎ তার নির্দিষ্ট কোনো চাকরি নেই, বেতনও নেই। তিনি কুয়েতে যাবেন, কিন্তু কাজ তাকেই খুঁজে নিতে হবে। মোটামুটি মৌখিকভাবে চুক্তিটা এমনই। বিনিময়ে যে বাংলাদেশি ব্যক্তি কুয়েতি নাগরিকের মাধ্যমে প্রবাসী ভিসা জোগাড় করেছেন, তিনি পাবেন কয়েক লাখ টাকা। এখান থেকে কুয়েতি নাগরিকও পাবেন একটা অংশ। কিন্তু যেহেতু এভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যাওয়া যায় না, ফলে এক্ষেত্রে সহায়তা নেওয়া হয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত দেশীয় কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির। কুয়েতি নাগরিকের দেওয়া ভিসা সামনে রেখে নিয়োগপত্র, আকামা, বেতন, কাজের ধরন, বিমান-টিকিটসহ সব কাগজপত্রের কাজ করে দেয় রিক্রুটিং এজেন্সি। বিনিময়ে তাদের দিতে হয় আরো কয়েক লাখ টাকা। এ পুরো প্রক্রিয়া পরিচিত ‘ফ্রি ভিসা’ নামে।

খাদেমুল ইসলাম এ ‘ফ্রি ভিসাতেই’ পাঁচ মাস আগে কুয়েত গিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে ৭ লাখ টাকা। কিন্তু যাওয়ার পর তিনি কোনো নির্দিষ্ট কাজ জোগাড় করতে পারেননি। বসে ছিলেন কয়েক মাস। কিছু খুচরা কাজও পেয়েছেন। কিন্তু বেতন কম। খাদেমুল বলেন, কুয়েতে যে এমন অবস্থা হবে আগে বুঝিনি। এখানে কাজ পাওয়া কঠিন। আমার আকামার মেয়াদ (কাজের অনুমতি) এক বছর। কিন্তু যে টাকা খরচ হয়েছে, এক বছরের মধ্যে সেটা তোলা সম্ভব না। আর যে কুয়েতি নাগরিক আমাকে নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে কুয়েত সরকার থেকে আমার ভিসা ম্যানেজ করে দিয়েছে, তিনি তো আমাকে চাকরি দেবেন না। খাদেমুল বলেন, তার কাজ ছিল ভিসা ম্যানেজ করা। বরং এক বছর পর আকামার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আমাকে আবার তার কাছেই যেতে হবে। আবার তাকে কয়েক লাখ টাকা দিতে হবে। এরা আবার অনেক সময় আকামার মেয়াদ বৃদ্ধি করে না। বরং কুয়েত সরকারের কাছে নতুন কাউকে আকামা দেওয়ার জন্য আবেদন করে। তাহলে সে বেশি টাকা পাবে। তখন তো আমাদের অবৈধ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

ব্যর্থ হয়ে ফেরা শ্রমিকের সংখ্যা কত : কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়া, বেতন কম, আকামা নবায়ন না হওয়া, অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে শ্রমিকরা ফিরে আসেন। দেশে ফিরেও নতুন করে ভুগতে হয় ঋণ পরিশোধের চাপে। কিন্তু এমন ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা কত- বাংলাদেশে তার কোনো হিসাব নেই। তবে যেসব শ্রমিক অবৈধ হয়ে পড়ায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন কিংবা তাদের আউট পাস দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। এসব আউট পাস নিয়ে ফেরত আসা শ্রমিকের একটা হিসাব আছে। ২০২৩ সালে এরকম কর্মীর সংখ্যা ৮৬ হাজারের বেশি। আর ২০২৪ সালের প্রথম তিন মাসে ফেরত এসেছে ১৫ হাজার। সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরে আউটপাস নিয়ে ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা বছরে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার। যদিও সামগ্রিকভাবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা এর কয়েকগুণ বেশি বলেই মনে করা হয়। কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে।

এ বিষয়ে আসলে দায় কার- জানতে চাইলে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, শ্রমকিদের ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার একক কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, যারা ফ্রি ভিসায় যাচ্ছে আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে সেখানে টাকাটার লেনদেন হয় মূলত আত্মীয়-স্বজনদের কাছেই। এখানে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি শুধু সরকারি আনুষ্ঠানিকতাটা করে দেয়। সুতরাং এখানে পুরো দায়টা শুধু এজেন্সিগুলোকে দিলে হবে না। তিনি বলেন, বায়রা যদি কোনো এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ পায়, সেটির সত্যতা থাকলে সেই এজেন্সির লাইসেন্স বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে।

প্রতিকার কী? : শ্রমিকদের অভিযোগ দেখভালের জন্য বিএমইটি কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটিতে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে অভিযোগ পড়েছে ২ হাজারের বেশি। তবে এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে অর্ধেকেরও কম। আর জরিমানা আদায় হয়েছে ৭ কোটি টাকার বেশি। জরিমানার টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভুক্তভোগী কর্মীদের ফেরত দেওয়া হয় বলে জানায় বিএমইটি। এর বাইরে কোনো কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত করার মতো পদক্ষেপও নেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এসব অনিয়ম আগে থেকেই কেন ধরা পড়ছে না? এসব বিষয় জানতে চাইলে সংস্থাটির কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে মন্ত্রণালয় থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যদিও অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফরমের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর শরীফুল হাসান বলেন, শ্রমিকরা যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। প্রতিটা কর্মী যখন বিদেশ যান, তার বিদেশ যাওয়ার আগে বিএমইটি থেকে একটা স্মার্ট কার্ড বা ছাড়পত্র দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে স্মার্ট কার্ড দেওয়ার মানেই হলো বিদেশে তার চাকরির তথ্যটা ঠিক আছে, তার কোম্পানিটা ঠিক আছে। সরকার যখন বলছে সবকিছু ঠিক আছে, তারপর সেদেশে গিয়ে যদি কর্মী কাজ না পায় বা দেখে যে তার বেতন অনেক কম তখন সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রকারী কর্তৃপক্ষেরই ব্যর্থতা। তার মতে, কর্মী, এজেন্সি এবং নিয়োগকারী পক্ষ সবখানেই সচেতনতা এবং স্বচ্ছতা দরকার। আর প্রতারণার যে চক্র গড়ে উঠেছে, সরকারকেই সেটি ভাঙতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close