কবির কাঞ্চন

  ০৪ মে, ২০২৪

অসহ্য পৃথিবী

কদিন ধরে তাপপ্রবাহে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অনেক দেশ। চারদিকে খাঁ-খাঁ রৌদ্দুর। সূর্যের তেজ একটুও কমছে না। পথে-ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি বাসায়ও স্বস্তি নেই। চারদিকে গরম আর গরম। আগের মতো করে পথের ধারে এখন আর সারি সারি বৃক্ষ নেই। ঘর্মাক্ত পথিক একটু প্রশান্তি খুঁজে পেতে মরিয়া হয়। কিন্তু আশপাশে কোনো বৃক্ষরাজি না থাকায় নিরুপায় হয়ে সে গন্তব্যে ছুটে চলে। গরমে পাখার বাতাসও কোনো কাজে আসছে না। তীব্র গরমে বাতাসের স্নিগ্ধতা নেই।

এমনই যখন অবস্থা তখন একদল মানুষ সূর্যের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সবার একই ধারণা, সূর্য তাদের ওপর প্রচণ্ড রেখে আছে বলেই হয়তো এমন তীব্র গরম বিলাচ্ছে। যেই ভাবনা সেই কাজ। সকাল থেকে চলতে চলতে মধ্যদুপুর পর্যন্ত গড়াল। প্রখর রোদের তাপে দলের সবাই ঘেমে একাকার। এরই মধ্যে তারা সূর্যের প্রতিনিধির কাছে পৌঁছে গেল। সবার চোখে-মুখে হতাশা আর ক্লান্তির ছাপ দেখে সূর্যের প্রতিনিধি আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

- তোমাদের এ কী হাল হলো! আর সবাইকে এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন? তা ছাড়া এমন তাপপ্রবাহের মধ্যে তোমরা কার কাছে এসেছো?

মানুষের দলটির প্রতিনিধি সামনে এগিয়ে এসে অভিযোগের সুরে বলল,

- আমরা এসেছি আপনার কাছে। আমাদের যে হাল দেখছেন তা নিয়ে কথা বলতে আমরা এখানে এসেছি। আমরা হঠাৎ করে খুব সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছি।

- কীসের সমস্যা?

- আমাদের সবই ঠিকঠাকমতো চলছিল। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আপনি এত বেশি তাপ দিতে শুরু করেছেন, যা আমরা সহ্য করতে পারছি না। আমাদের শান্তির পৃথিবী এখন অসহ্য এক পৃথিবীতে পরিণত হয়েছে। প্লিজ, আগের মতো করে তাপ দিয়ে আমাদের স্বস্তিতে বাঁচতে দিন।

সূর্যের প্রতিনিধি হো হো করে হেসে উঠে বললেন,

- তাহলে এই কথা! তোমরা মনে করছো আমি তোমাদের কষ্টে রেখেছি?

- হ্যাঁ, আপনিই তো অসহ্য গরমের মধ্যে রেখে আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে চলেছেন।

- এই হলো তোমাদের মূল সমস্যা। তোমরা মূলের পেছনে না ছুটে অনুমান নির্ভর হয়ে পথ চলো। তা ছাড়া তোমাদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে।

মানুষের দলটির সব সদস্য সমস্বরে আওয়াজ করল,

- আমাদের বিরুদ্ধে আবার কীসের অভিযোগ জমা পড়েছে?

- তোমাদের কী সেই অভিযোগকারীদের মুখোমুখি হওয়ার মতো সৎ সাহস আছে?

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর মানুষের দলটির প্রতিনিধি আস্তে করে বলল,

- হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই সেই অভিযোগের সত্যতার মুখোমুখি হতে চাই।

সূর্যের প্রতিনিধি মৃদু হেসে বললেন,

- তাহলে একটু অপেক্ষা করো। আমি প্রথম অভিযোগকারীকে আসতে বলি।

সবাই অভিযোগকারীর জন্য অপেক্ষা করছে। এর মধ্যে সেখানে এসে হাজির হয় একটি বিলুপ্তপ্রায় বৃক্ষ। সূর্যের প্রতিনিধি সেই বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে বললেন,

- প্রিয় বন্ধু, তুমি আরেকটু সামনে এসে তোমার অভিযোগের কথা জানাও।

সূর্যের প্রতিনিধির কথামতো বৃক্ষ আরো কাছে এসে বলতে লাগল,

- আমি তালিপাম জাতের গাছ। একসময় আমরা এই দেশের বনভূমিতে ছিলাম। কিন্তু এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য টিকে আছি। ইতিমধ্যে আমাদেরও প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই মানুষসহ সব প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, খাদ্য আমরা বৃক্ষরাজি সরবরাহ করে থাকি। তীব্র গরমে তাদের ছায়া দিয়ে প্রশান্তি দিই। আরাম করে থাকার জন্য তারা আমাদের ব্যবহার করে। তবু তারা নির্দয় পাষাণ হয়ে আমাদের সাবাড় করে চলেছে। কারণে-অকারণে আমাদের ওপর করাত চালাচ্ছে। তাতেও আমরা অভিযোগ করিনি। আমাদের আশা ছিল তারা একটা গাছ কাটলে অন্তত নতুন করে আরেকটা গাছ রোপণ করবে। কিন্তু না তারা তা না করে দিনে দিনে আমাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে চলেছে। যার ফলে শুধু আমরা নই; আমাদের মতো অসংখ্য বৃক্ষরাজি পরিবেশ থেকে হারিয়ে গেছে। বিপন্ন হওয়ার পথে আছে অনেকেই। অবশেষে আমরা সূর্যের প্রতিনিধির কাছে মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি।

বৃক্ষের সব কথা শোনার পর সূর্যের প্রতিনিধি মানুষের দলটির প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

- সবই তো নিজের কানে শুনলে। এখন বলো এই বৃক্ষের অভিযোগটি কি সত্য নাকি মিথ্যা?

মাথানিচু করে মানুষের দলটির প্রতিনিধি জবাব দিল,

- হ্যাঁ, তালিপাম গাছটি একটু আগে যা যা বলেছে সবই সত্য। আমরা আসলেই ওদের প্রতি অবিচার করেছি। আর এ কারণে হয়তো এই গরমে একটু ছায়াশীতল পরিবেশ পর্যন্ত পাচ্ছি না। আমরা মানুষের পক্ষ থেকে বৃক্ষের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সেই সঙ্গে কথা দিতে চাই, এখন থেকে আমরা বৃক্ষকে পরম বন্ধু ভাবব। প্রয়োজনে একটি গাছ কাটলে কমপক্ষে দশটি গাছ রোপণ করব।

মানুষের দলটির প্রতিনিধির এমন আশ্বাসে আনন্দিত হয়ে তালিপাম গাছটি সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,

- সূর্যের প্রতিনিধি, আপনাকে বলছি, মানুষের প্রতি আমরা আমাদের অভিযোগ তুলে নিয়েছি। এখন থেকে আমরা ওদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই।

সূর্যের প্রতিনিধি মানুষের দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন,

- বৃক্ষের প্রতিনিধি তোমাদের প্রতি তাদের অভিযোগ তুলে নিয়েছে। কিন্তু আরো কিছু অভিযোগকারী বাইরে অপেক্ষা করছে। এখন তাদের ডেকে পাঠাচ্ছি।

এরই মধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয় একদল মানবশিশু। শিশুদের প্রতিনিধি সামনে এসে সালাম জানিয়ে বলতে লাগল,

- আমরা মানবশিশু। পৃথিবী আমাদের ঠিকানা ছিল। আমরাও হেসেখেলে বড় হতে চেয়েছিলাম সেখানে। কিন্তু আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মরা আমাদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যায়নি। ফলে আমরা রোবোটিক পৃথিবীতে টিকতে পারছিলাম না। তাই সূর্যের প্রতিনিধির কাছে এসে নালিশ করেছি।

শিশুদের প্রতিনিধির কাছ থেকে কথাগুলো শোনার পর মানুষের দলটির সব সদস্য লজ্জায় মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

পাশ থেকে সূর্যের প্রতিনিধি জিজ্ঞেস করলেন,

- এখন বলো, ওরা যা বলেছে তা কী সত্য নয়?

মানুষের দলটির প্রতিনিধি দায় স্বীকার করে বলল,

- হ্যাঁ, শিশুরা কখনো মিথ্যা কথা বলে না। সত্যি আমরা ওদের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা এখন অনুতপ্ত। কথা দিচ্ছি, এখান থেকে ফিরে গিয়ে আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে কাজ করব।

মানুষের দলটির প্রতিনিধির এমন প্রতিশ্রুতির কথা শুনে শিশুরা আনন্দে তাদের অভিযোগ তুলে নিল।

এরপর একে একে সেখানে এসে হাজির হলো বনের পশুপাখি, পানি, বায়ু, মাটি ও শব্দের প্রতিনিধি।

মানুষের দলটির সব সদস্য তাদের সবাইকে একসঙ্গে উপস্থিত হতে দেখে বিস্মিত হয়ে সূর্যের প্রতিনিধিকে জিজ্ঞেস করল,

- এদের আবার কীসের অভিযোগ!

- সেটা ওদের কাছ থেকেই শোন।

প্রথমে বনের পশুপাখিদের প্রতিনিধি সামনে এসে বলল,

- সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে আমরা মানুষের পাশে থেকেছি। তাদের আনন্দ দিয়েছি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করেছি। কিন্তু তারা স্বার্থপরের মতো আমাদের আবাসস্থল ধ্বংস করে আমাদের বহু প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হয়েছে। শুধু ওদের কারণেই আমাদের বেঁচে থাকা আজ হুমকির মধ্যে পড়েছে।

অবশেষে আমরা সূর্যের প্রতিনিধির কাছে ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি।

সূর্যের প্রতিনিধি মানুষের দলটির প্রতিনিধিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

- এখন বলো, এদের অভিযোগটি কি সত্য নাকি মিথ্যা?

মানুষের দলটির প্রতিনিধি এবারও ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল,

- হ্যাঁ, ওরাও ঠিক বলেছে। আমরা আসলে ওদের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেছি। এর জন্য আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

বনের পশুপাখিদের প্রতিনিধি খুশি হয়ে বলল,

- প্রিয় প্রতিনিধি, আপনাকে বলছি, মানুষের প্রতি আমরা আমাদের অভিযোগ তুলে নিয়েছি। এখন থেকে আমরা ওদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে চাই।

- আচ্ছা।

এরপর একে একে সামনে এসে অভিযোগ করতে থাকে পানি, বায়ু, মাটি ও শব্দের প্রতিনিধি। তাদের সবার একটাই কথা মানুষজন তাদের প্রতিনিয়ত ব্যবহারের নামে অপব্যবহার করছে। তা নিয়েও তাদের কোনো অভিযোগ নেই। তাদের অভিযোগ হলো তারা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হয়েও নিত্য মানুষ কর্তৃক দূষিত হচ্ছে।

এবারও মানুষের দলটির প্রতিনিধি সব অভিযোগ অকপটে স্বীকার করে নিয়ে বলল,

- এখন পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ উঠে এসেছে তার সবগুলোই সত্য। আমরা আসলেই এই অপকর্মগুলো করে আসছি। এখন আমরা বুঝতে পারছি, কেন আমাদের ওপর সূর্যের এত এত রাগ। আমরা সবাই করজোড়ে ক্ষমা চাচ্ছি। এখান থেকে গিয়ে আমরা সব মানুষকে সত্য ও সুন্দর পথে চলতে বলব। এত দিন ধরে যাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছি তাদের সঙ্গে বন্ধুর ন্যায় আচরণ করব।

সূর্যের প্রতিনিধি হো হো করে হেসে উঠে বললেন,

- তোমরা মানুষরা বড় বোকা! সব সময় ভুল পথে পা বাড়িয়ে সুখ খোঁজো।

- ভুল পথ মানে!

- এই যেমন ধরো, পৃথিবীতে অসহ্য গরম পড়ছে। তোমরা সেখানে টিকতে পারছিলে না। চলে এলে আমার কাছে। অথচ তোমরা নিজেরাই জানতে, এই পৃথিবীর অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে সূর্যও একটি। সৃষ্টিকর্তার হুকুম ছাড়া সৃষ্টির কোনো উপাদানেরই কোনো ক্ষমতা নেই, কাউকে ভালো রাখার বা খারাপ রাখার। আমি কী করে পৃথিবীতে গরম বেশি দিতে পারি?

মানুষের দলটির প্রতিনিধি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,

- তাহলে একটু আগে যে বললেন, ওরা সবাই আমাদের বিরুদ্ধে আপনার কাছে অভিযোগ দিয়েছে বলে আপনি পৃথিবীতে গরম বাড়িয়ে দিয়েছেন?

- ওটা ছিল তোমাদের জন্য আরেকটা ফাঁদ!

এবার মানুষের দলটির প্রতিনিধি অসহায়ের মতো হয়ে বলল,

- আমরা এখন কী করব?

সূর্যের প্রতিনিধি মোলায়েম কণ্ঠে বললেন,

- আর দেরি না করে এখান থেকে ফিরে যাও। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close