আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

  ১৮ মে, ২০২৪

পক্ষিরাজ

পাখিটার নাম ফিঙে। খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু তাতে কী? তার আছে বুকভরা সাহস। এই তো একটু আগেই বিশাল এক চিলকে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে। চিল আর ফিঙের যুদ্ধটা রাতুল বেশ উপভোগ করছিল। রাতুলের দাদুও বারান্দায় বসে সে দৃশ্য দেখছিলেন।

রাতুলের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। এইটুকুন একটা পাখি, এত বড় চিলকে নাকানিচোবানি খাইয়ে ছাড়ল!

অবশ্য ফিঙে উচিত শিক্ষাই দিয়েছে। তা না করলে চিলটা ছোঁ মেরে ফিঙের ছানাগুলো নিয়ে যেত।

হতচ্ছারা চিল কোনোভাবেই ফিঙের সামনে টিকতে পারল না। শেষে প্রাণ নিয়ে পালাল।

চিলকে পালাতে দেখে রাতুল কি যে খুশি হলো। হাততালি দিয়ে দাদুকে বলে, ফিঙেটার সাহস আছে। তাই না দাদু?

দাদু পান চিবানো মুখে বলেন, সাহস তো থাকবেই। রাজা বলে কথা।

রাজা! পাখিদেরও রাজা থাকে?

রাতুল বেশ অবাক হলো যেন। দাদু তখন বললেন, থাকবে না কেন? পশুদের যেমন রাজা আছে। তেমনি পাখিদেরও রাজা আছে। পাখিদের রাজাকে বলা হয় পক্ষিরাজ। ফিঙেই হলো সেই পক্ষিরাজ। ফিঙে কীভাবে পক্ষিরাজ হলো শুনবে?

রাতুল মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, হুম; শুনব।

দাদু বলেন, তাহলে শোনো- সে অনেক বছর আগের কথা। বনের পাখিরা ঠিক করল পশুরাজ সিংহের মতো তাদেরও একজন পক্ষিরাজ থাকবে।

কিন্তু কাকে রাজা বানানো যায়, তা নিয়ে শুরু হলো আরেক ঝামেলা। ঈগল, চিল, টিয়ে, ময়না, ময়ুরসহ সবাই-ই রাজা হতে চায়। শুধু ফিঙেই চুপচাপ বসে থাকে। সে তো শ্রমিক পাখি। পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষা করে। এতেই সে সুখি। তা ছাড়া গায়ের রং কুচকুচে কালো। এ কারণে অনেকেই তাকে পছন্দ করে না।

একবার এক ময়ুরীর বিয়েতে গিয়ে কি অপমানটাই না পেল! ময়ুরীর সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল বলে ময়ুরীর মা অনেক কটু কথা শুনিয়েছে। ফিঙেকে ডেকে নিয়ে বলে, পানিতে কখনো নিজের চেহারা দেখেছিস? কি বিচ্ছিরি দেখতে তুই। তুই কীভাবে আমার মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালি?

ফিঙের সেদিন খুবই খারাপ লেগেছিল। কষ্টে যেন বুক ফেটে যায়। পরে নিজেকে এই বলে সান্ত¡না দিল- আল্লাহই তো আমাকে কালো রঙে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যদি আমাকে কালোতে ভালোবাসেন, তাহলে অন্যের কথায় কী আসে যায়!

এদিকে ঈগল আর চিলের মাঝে কথার যুদ্ধ বেধে যায়। ঈগল বলে, আমার বিশাল শরীর, শিকারি থাবার কথা কে না জানে? আমার সঙ্গে টক্কর দেয় এমন কেউ আছে? সুতরাং আমাকেই পক্ষিরাজ করা হোক।

ঈগলের কথা শুনে চিল বলে ওঠে, থাবার বড়াই দেখিও না। থাবাই যদি সব হয়, তাহলে আমিই বা কম কীসে?

চিলের এমন কথায় ঈগল গজগজিয়ে ওঠে। বলে, বেশ, তাহলে দেখা যাক কার থাবায় কত জোর?

ঈগল আর চিলের বাগবিতণ্ডায় বানর বিরক্ত হয়ে বলে, থামো তোমরা! এখানে কী লড়াই করতে এসেছো?

ঈগল আর চিল চুপ হয়ে যাওয়ার পর বানর বলে, আগামীকাল ঠিক দুপুরে, জোহরের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই কালো পাহাড়ের চূড়ায় যে আরোহণ করবে, সেই-ই হবে পক্ষিরাজ। তাকেই পরানো হবে রাজমুকুট।

বানরের এই প্রস্তাব পাখিরা মেনে নেয়।

পরদিন ভোরে, পাখিরা প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। প্রস্তুতি বলতে পোশাক পরিধান আর বাহারি সাজগোছ। আসলে প্রত্যেকেই ধরে নিয়েছিল সেই-ই রাজা হবে। যেহেতু রাজা হবে, সেহেতু পোশাকের গুরুত্বটাও ভাবতে হয়। সেই ভাবনা থেকেই টিয়ে পাখি সেজেছে প্রকৃতির আবরণে। পরনে সবুজ শাড়ি আর টুকটুকে লাল ঠোঁটের টিয়েকে বেশ লাগে। ওদিকে ময়নাও কানে গলায় সোনার গয়না পরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দোয়েল, কোয়েল, মাছরাঙা, বেনে বউ, কুটুম পাখির বৈচিত্র্যময় পোশাক আর বাহারি সাজগোছে যে কারো তাক লেগে যাবে। তবে সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়েছে ময়ুরের সাজ। এত চমকপ্রদ সাজ আর বর্ণীল পোশাক আগে কেউ দেখেনি। ময়ুরের সাজ অবশ্য এখনো অনেক বাকি রয়েছে।

পাখিরা সাজগোছ করছে তো করছেই। এদিকে বেলা গড়িয়ে যে দুপুর হতে চলল, সেদিকে কারো খেয়াল নেই। বানর তো রেগেমেগে আগুন। সেই সকাল থেকে কালো পাহাড়ে বসে আছে। কারো আসার নাম নেই।

পাখিদের রংবেরঙের পোশাক আর সাজগোছ দেখে ফিঙে খুবই খুশি হয়। মনে মনে বলে, যেই-ই রাজা হোক, তার ভেতরটা যেন বাইরের পোশাকের মতোই সুন্দর হয়।

এই বলে ফিঙে গোসল করতে পুকুরে যায়। টুপ করে দুটো ডুব দিয়ে পানি থেকে উঠে আসে। আর তখনই কাঠবিড়ালি এসে দুঃসংবাদটা দিল। কাঠবিড়ালি ছুটে এসে বলল, ভাই ফিঙে সর্বনাশ হয়েছে! দুষ্টু কাক তোমার ছানা নিয়ে গেছে।

এমন কথা শোনার পর ফিঙে কি বসে থাকতে পারে? সে তখনই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল।

সূর্য তখন মাথার ওপর থেকে একটু পশ্চিমে ঢলেছে। পাশের কোনো এক গ্রামের মসজিদ থেকে ভেসে এলো জোহরের আজান। ঠিক তখনই একটা পাখি উড়ে এলো কালো পাহাড়ের চূড়ায়। বনের জিরাফ তার লম্বা গলা উঁচিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো পাখিটা ঈগল কিংবা চিল নয়। বর্ণীল পেখমের ময়ুরও নয়। খরগোশ জিজ্ঞেস করল, কে?

জিরাফ তার লম্বা গলায় আনন্দের সুর তোলে বলে, এ যে আমাদের সবার প্রিয় ফিঙে।

ফিঙের নাম শুনতেই বানর নাচতে শুরু করে। আর বলতে থাকে-

ফিঙে হলো পক্ষিরাজ

মাথায় পরাও হিরের তাজ।

বানর, খরগোশ আর জিরাফের আনন্দ দেখে ফিঙের বুঝতে বাকি থাকে না, আল্লাহ তাকেই পক্ষিরাজের সম্মান দিয়েছেন। আল্লাহ চায়লে কি না পারেন?

ফিঙে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ততক্ষণে কাঠবিড়ালি ফিঙের ছানাদের নিয়ে হাজির। আসলে কাঠবিড়ালি ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলেছিল। এইটুকুন মিথ্যে না বললে যে ফিঙে পক্ষিরাজ হতে পারত না। অবশ্য এই মিথ্যের জন্য কাঠবিড়ালিও আল্লাহর কাছে মাফ চান। ওয়াদা করে, আর কখনো মিথ্যে বলবে না।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close