আবদুস সালাম

  ২৫ জানুয়ারি, ২০২০

কস্তুরী মৃগ

ধনপুরা রাজ্যে ধনসম্পদের কোনো অভাব ছিল না। রাজ্যের রাজা যেমন ছিলেন কড়া; তেমনি ছিলেন প্রজাবৎসল। তিনি অন্যায়কে কোনোভাবে প্রশ্রয় দিতেন না। প্রজাসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার জন্য সর্বদা চেষ্টা করতেন। জনহিতকর কাজ করতেন। নিয়মিত প্রজাদের খোঁজখবর রাখতেন। রাজা-রানির মনে কোনো অহংকার ছিল না। সাধারণভাবে জীবনযাপন করতে তারা পছন্দ করতেন। নানাবিধ কারণে ধনপুরার জনগণও রাজা-রানিকে ভালোবাসত। রাজার শাসনে সকলে সুখে-শান্তিতে বসবাস করত।

রাজার মনে একটা কষ্ট ছিল। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তিনি ধনপুরার জনগণের মঙ্গলের কথা ভাবতেন। তিনি আরো ভাবতেন তার মৃত্যুর পর কে হবেন ধনপুরার রাজা? কে রাজ্য শাসন করবেন? রাজা নির্বাচন নিয়ে কি রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে? রাজার মতো রানি, মন্ত্রী ও জনসাধারণের মধ্যেও এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। সবার মনোকষ্ট দূর করার জন্য রাজা-রানি প্রায়ই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতেন। সত্যি সত্যিই সৃষ্টিকর্তা এক দিন তাদের ডাকে সাড়া দেন। রাজা-রানি একসময় পুত্রসন্তানের পিতা-মাতা হন। এই সংবাদটি সেদিন মুহূর্তের মধ্যে ধনপুরার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজ্যজুড়ে খুশির বন্য বয়ে যায়। রাজকুমার ছোটবেলা থেকেই ছিল শান্ত স্বভাবের। সবার আদর-যতেœ সে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। প্রাসাদের অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে রাজকুমারের সখ্য ছিল। তাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটত। খেলার সাথীদের খুশি করার জন্য সে আপ্রাণ চেষ্টা করত। তাদের হাতে বিভিন্ন উপহার তুলে দিত। মাঝে মাঝে সবাইকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করত। মনের মধ্যে তার কোনো ঈর্ষা ছিল না। রাজা-রানি ছেলের আচার-আচরণে সন্তুষ্ট ছিলেন। এভাবে দেখতে দেখতে রাজকুমার বেশ বড় হয়ে যায়।

দেশভ্রমণ ছিল রাজকুমারের শখ। রাজ্যের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে তার খুব ভালো লাগত। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সে প্রায়ই দেশ ভ্রমণে বের হতো। এক দিন রাজকুমার সঙ্গীদের নিয়ে বনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় তার নজরে পড়ে সুন্দর একটি হরিণ। সে ফাঁদের মধ্যে আটকে ছিল। তাদের কাছে আসতে দেখে হরিণটি ভয়ে ছটফট করতে থাকে। একপর্যায়ে সে কান্নাকাটি করে। তাকে হত্যা না করার জন্য অনুনয়-বিনয় করে। সঙ্গীরা তাকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হলে রাজকুমার তাদের বাধা দেয়। হরিণটাকে দেখে রাজকুমারের মায়া হয়। সে হরিণকে অভয় দিয়ে বলে, ‘তোমার কোনো ভয় নেই। কেউ তোমাকে হত্যা করবে না। আমরা তোমাকে মুক্ত করে দেব।’ রাজকুমারের অনুরোধে সবাই হরিণটাকে ফাঁদ থেকে মুক্ত করে দিল। হরিণ মুক্ত হয়ে সবার প্রতি খুশি হয়। সে বলে, ‘আমি হরিণদের সর্দার। আমার বাসায় দুটি শাবক রয়েছে। আমার মৃত্যু হলে তারাও মারা যেত। তোমরা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ। আমি তোমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। যদি কখনো আমার সাহায্যের প্রয়োজন হয়, তাহলে এ বনে চলে আসবে। তোমাদের সাহায্য করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’ এরপর হরিণ বিদায় নিয়ে বনের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। রাজকুমার প্রাসাদে ফিরে এসে সব ঘটনা রাজা-রানিকে খুলে বলে। পুত্রের মহানুভবতার কথা শুনে রাজা-রানি খুব খুশি হন।

এভাবে আরো কয়েক বছর গত হলো। রাজকুমার যখন কৈশোরে উপনীত হয় ,তখন সে এক দুরারোগ্য চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। ধনপুরার বড় বড় চিকিৎসক রাজকুমারের চিকিৎসায় এগিয়ে আসেন। কিন্তু কেউই তাকে সুস্থ করে তুলতে পারে না। রাজা-রানির মনে আবার দুঃখের ছায়া নেমে আসে। কোনো কাজে তাদের মন বসে না। এক দিন পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে এক বিখ্যাত কবিরাজকে ডেকে আনা হয়। কবিরাজ রাজকুমারকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাজাকে বলেন, ‘রাজকুমারের চর্মরোগ সারাতে হলে কস্তুরী প্রয়োজন। কস্তুরী মেশানো পানি দ্বারা এক সপ্তাহ গোসল করলে রাজকুমার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন। যত দ্রুত সম্ভব হরিণের কস্তুরী জোগাড় করতে হবে। নতুবা রাজকুমারকে বাঁচানো যাবে না।’ ‘কস্তুরী কীভাবে জোগাড় করব?’ রাজার প্রশ্নের উত্তরে কবিরাজ বলেন, ‘দশ বছর বয়সি পুরুষ হরিণের নাভিতে পাওয়া যায় ওই কস্তুরী। যে হরিণের নাভিতে কস্তুরি থাকে তার শরীর থেকে তীব্র সুঘ্রাণ বের হয়। কস্তুরী মৃগের বসবাস পার্বত্য অঞ্চলে। এরা দেখতে ছাগলের মতো। এরা নিরিবিলি বাস করে। বিচরণ করে একান্ত নির্জনে। এদের লোম মোটা পালকের মতো। কস্তুরী মৃগের ওপরের মাড়ি থেকে গজদন্তের মতো দুটি দাঁত ছোট আকারে বের হয়। আর হ্যাঁ যে হরিণটির নাভিতে কস্তুরী থাকে, সে নিজে কিছুই বুঝতে পারে না। তার নাকে যখন এই সুগন্ধ এসে লাগে, তখন সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে এই সুঘ্রাণের উৎস খোঁজার জন্য। অথচ সে বুঝতে পারে না যে, সেই সুঘ্রাণ তার শরীর থেকে বের হচ্ছে। অনেক সময় এই কস্তুরী হরিণের দেহ থেকে এমনিতেই খসে পড়ে। আপনারা চেষ্টা করলে কস্তুরী মৃগের সন্ধান পেয়ে যাবেন।’

কবিরাজের কথা শুনে রাজা-রানি সমস্যায় পড়ে গেলেন। তারা এখন কীভাবে হরিণের কস্তুরী জোগাড় করবেন? রাজপ্রাসাদের সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। এমন সময় রাজকুমারের সঙ্গী-সাথীদের হরিণ সর্দারের কথা মনে পড়ে গেল। তাদের বিশ্বাস, হরিণ সর্দারের সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয় একটা উপায় বের হবে। কালই আমরা হরিণ সর্দারের সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমাদের যেভাবেই হোক রাজকুমারকে বাঁচাতেই হবে। পরদিন সকালে সঙ্গীরা হরিণ সর্দারের সঙ্গে দেখা করার জন্য বনের মধ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তারা হরিণ সর্দারের দেখা পেল না। অবশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে তারা একটা গাছের নিচে বিশ্রাম করতে থাকে। ঠিক সেই সময় ওই পথ ধরে হরিণ সর্দার হেঁটে যাচ্ছিল। সে দূর থেকে রাজকুমারের সঙ্গীদের চিনতে পারে। সে তাদের কাছে ছুটে আসে। সঙ্গীরা তাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়। তারা হরিণ সর্দারকে সব ঘটনা খুলে বলে। সবকিছু জানার পর হরিণ সর্দার বলে, ‘তোমরা চিন্তা করবে না। আমি যেভাবেই হোক তোমাদের কস্তুরী জোগাড় করে দেব। এর জন্য আমাকে দুদিন সময় দিতে হবে। তোমরা দুদিন পর আমার সঙ্গে দেখা করবে।’

দুদিন পর সঙ্গীরা আবার হরিণের সর্দারের সঙ্গে দেখা করার জন্য বনের মধ্যে প্রবেশ করে। নির্দিষ্ট স্থানে তারা হরিণের সর্দারের সঙ্গে দেখা করে। হরিণ সর্দার তাদের কস্তুরী উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। এরপর সঙ্গীরা মহামূল্যবান কস্তুরী নিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে। কস্তুরীর সুঘ্রাণের পুরো রাজপ্রাসাদ সুবাসিত হয়। কবিরাজ কস্তুরী দিয়ে ওষুধ তৈরি করেন। কস্তুরী মিশ্রিত পানি দিয়ে রাজকুমারকে গোসল করানো হয়। এক সপ্তাহ পর রাজকুমার সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে। রাজকুমারের সুস্থতায় রাজা-রানি যেমন খুশি হন; ঠিক তেমনি ধনপুরা রাজ্যের সব জনগণ খুশি হয়। রাজ্যজুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close