মেহেরুন ইসলাম

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

আম কুড়ানো দিন

কী যে কাঠফাটা রোদ্দুর! মাঠঘাট ফেটে চৌচির। কোথাও যেন একটু শান্তি নেই। কী বিশ্রী গরম! এ সময় বাড়ি থেকে কোথায় যেতেও মন চায় না। খাই বা না খাই, খোলামেলা পরিবেশে নিজের বাড়ি থাকাটাই যেন শান্তির। কিন্তু এসব পোলাপানরে কে বোঝাবে? আর কেই-বা শোনে কার কথা?

মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য একদম পাগল করে ফেলেছে। কদিন ধরে কান ঝালাপালা করে তুলছে। বড় ছেলেটা কই বোঝাবে, তা না সেও ছোটগুলোর মতো বায়না করছে। আজকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে গেছে ছোট মেয়ে জুঁই। কালকে মামাবাড়ি না নিয়ে গেলে সকাল থেকে আর ভাত-ই মুখে তুলবে না সে।

পরের দিন সকালের বাসে রওনা হলাম মোংলার উদ্দেশে। সোনাডাঙা থেকে বাসে উঠেছি। ওদের বাবা অফিসে একটি মিটিং থাকায় আমাদের সঙ্গে আসতে পারেনি, কয়েক দিন পরে আসবে বলেছে। চারটা সিট নিয়েছি কিন্তু একটা সিট ফাঁকাই পড়ে আছে। সারাক্ষণ ঝগড়াঝাঁটি করলেও তিন ভাই-বোনের বেশ মিল। ওরা তিনজনে মিলে দুই সিটে বসেছে। জিহাদ আর জিহানের মাঝখানে জুঁই বসেছে। খুব মজা করছে তিন ভাই-বোন। ঝালমুড়ি, আমভর্তা খাচ্ছে।

দিগরাজ আসতে আসতে দেখি জুঁই ঘুমিয়ে পড়েছে, জিহাদের কোলে মাথা। আমার কাছে জুঁইকে নিতে চাইলেও দিল না। আইসক্রিম দেখে জিহান বায়না ধরল- আম্মু আইসক্রিম খাব, কিনে দাও না।

দুইটা আইসক্রিম নিয়ে টাকা দিচ্ছি তখন জুঁই লাফায় উঠে বলে- আমার আইসক্রিম কই? আমি তো ঘুমায়নি। দেখছিলাম আমার কথা কারোর মনে আছে কি না!

ওর কথা শুনে আমরাসহ আশপাশের সিটের মানুষও হেসে উঠল। আমি আরো একটি আইসক্রিম কিনে ওর হাতে দিলাম। আইসক্রিম খেতে খেতে আমরা মোংলা বাসস্ট্যান্ডে চলে আসি। সেখান থেকে ওদের বড় মামা আমাদের রিসিভ করে বাসায় নিয়ে যায়।

খেয়া মানে নদী পার হওয়ার সময় তিন ছেলেমেয়ের সে কী আনন্দ! জিহাদ সেভেনে, জিহান ফাইভে আর জুঁই এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি। এত বড় দুটো ছেলে তাও বাচ্চাদের মতো করছে। গ্রামের খোলা পরিবেশে আসলে ওরা যেন সব ভুলে যায়!

তিনজনের সঙ্গে আরেকজন যোগ হয়েছে। সে হলো ওদের মামাতো বোন সাবা। সাবা জুঁইর একটু বড় হবে। চার ভাই-বোন মিলে বাড়িটাকে যেন মাছের বাজার বানিয়েছে। সারা দিন কী যে হইচই করে পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখে। আমার আবার নিষেধাজ্ঞা আছে। আগেই পড়িয়ে এনেছে- ‘মামাবাড়ি গেলে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না।’

আর ক্যামনে বা করব! ওদের মামা-মামির নিষেধাজ্ঞা আরো। কিছুই বলা যায় না। এমন ভাব- আমি যেন ছেলেমেয়ের কেউই না।

সারা দিন ছোটাছুটি, মাতামাতি করে। পশুর নদীর ঘোলা পানিতে ঝাঁপিয়ে গায়ের কী হাল যে করে! মাইরের ভয়ে আমার ধারেকাছেও আসে না। ওদের নানি আবার সুন্দর করে গোসল করিয়ে দেয়।

চার ভাই-বোনের আবার ছোট মামার সঙ্গেও খুব ভাব। বিকেল হলেই বাচ্চারা ছোট মামার পিছু নেবে। হয় কফিশপ, না হয় পার্কে নিয়ে যেতেই হবে। চারটে মিলে ওরে একদম শায়েস্তা করে ছাড়ে।

তখনো পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়নি। সূর্যটা ডুবু ডুবু। ছোট মামার সঙ্গে চার ভাই-বোন বাসায় ফিরেছে সবার জন্য আইসক্রিম আর ঝালমুড়ি নিয়ে। সবাই মিলে মজা করে সেটিই খাচ্ছিলাম। তার মধ্যেই ঝড় শুরু হয়ে গেল। পুকুরপাড়ে দুটি বড় বড় আমগাছ। ঝড়ের সঙ্গে খুব বাতাসও। আম পড়তে শুরু করল। তা দেখে বাচ্চারা আর বসে থাকল না। সবগুলো আম কুড়াতে ছুটে গেল। আমিও লোভ সামলাতে পারলাম না। ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম। ওদের দলে বেশি মানুষ, ছোট মামাও ওদের সঙ্গে আম কুড়াতে নেমেছে। আহা কী মজা! জুঁই আর সাবা তো তেমন কুড়াতে পারছে না। সবাই কুড়িয়ে দিচ্ছে আর ওরা সেটি ফ্রকে কোঁচড় বানিয়ে রাখছে। আম কুড়াতে কুড়াতে বৃষ্টি শেষ হয়ে গেল। সবাই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। বাচ্চাগুলো শীতে কাঁপছে। কোনোমতে হাত-পা ধুয়ে কাঁথার মধ্যে ঢুকে পড়ল। ওদিকে যে ওদের নানি খেতে ডাকছে, তাতে কারোর কোনো কর্ণপাত নেই। বারবার ডাকা সত্ত্বেও একটি বাচ্চাও খেতে গেল না। খাবে আর কীভাবে? বিকেলবেলা ছোট মামার সঙ্গে বাইরে গিয়ে যা-তা খেয়ে পেট ভরে আসছে।

সকাল হওয়ার আগেই সবগুলোর ঘুম ভেঙে যায়। সবাই ভুলে গেলেও জিহান আমের কথা একদম ভোলেনি। আম্মু আমরা যে রাতে আম কুড়িয়েছিলাম তা কই রাখছো?

রান্নাঘরে উত্তর দিতেই দৌড়ে যায়। আম দেখে খুশিতে চিল্লানি দেয়।

কত্ত আম কুড়িয়েছি...

ওর চিল্লানিতে বাকি বাচ্চাদের ঘুম ভাঙে, তারাও এসে হাজির।

জুঁই বলে আমি বড় আমটা নেব।

তুই তো একটা আমও কুড়াসনি, তোকে আর সাবাকে কোনো আমই দেব না। কি ঠিক বলেছি না ভাইয়া?

জিহাদ, জিহানের কথায় মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক সম্মতি জানাল।

জুঁই, সাবার মন খারাপ হয়ে গেল। কেন ভাইয়া? আমরা আম না কুড়ালেও কী, আমরা তো ঠিকই ওগুলো কোঁচরে ধরে রেখেছিলাম।

ধুর, ওটা কোনো কষ্ট হলো নাকি? তোরা এখন এখান থেকে যা তো।

না, আমরা আম না নিয়ে যাব না।

চারজন মিলে চলছে তুমুল তর্ক-বিতর্ক। মারামারি লেগে যাওয়ার উপক্রম। আর সেই মুহূর্তেই বড় মামার আগমন। বড় মামাকে সবাই বাঘের মতো ভয় পায়।

কীরে, সকাল সকাল তোরা এত চিল্লাপাল্লা করছিস কেন?

আব্বু শোনো না, জিহাদ আর জিহান ভাইয়া আমাদের আমের ভাগ দিতে চাইছে না।

কেন জিহাদ?

মামা, ওরা তো আম কুড়াইনি। আমরা কুড়ায়ছি আর ওরা শুধু ধরে রেখেছে।

জিহাদ তুমি সবার বড় অথচ তোমার এখনো বুদ্ধি হলো না। ওরা আম না কুড়াক, আম কুড়াতে তো তোমাদের সাহায্য করেছে। তাহলে কি ওরা ভাগ পায় না?

জি মামা, পায়।

আমগুলো আমাকে দাও, আমি সমান ভাগ করে দিচ্ছি।

তারপর মামা আমগুলো সমানভাবে চার ভাগ করে দিলেন।

চার ভাই-বোন এবার মহাখুশি। কেউ আচার বানাবে, কেউ জেলি বানাবে, কেউ জুস বানাবে, কেউ ভর্তা করবে- কত্ত কত্ত প্ল্যানিং।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close