এস আর শানু খান

  ০৫ মে, ২০১৮

তাল কুড়ানো দিন

কোনো রকম আজান কানে গেলেই বিছানা ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যেই বের হয়ে পড়ে শফিক আর তরিক। শফিকের আপন চাচাতো ভাই তরিক। পারিবারিকভাবে দুই পরিবারের মধ্যে বিশাল দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও তাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। শফিকের মায়ের থেকে তরিকের মা একটু দাজ্জাল টাইপের। পারিবারিকভাবে যতই ঝামেলা থাকুক না কেন, শফিকের মা মনে করেন যে, মারামারি, কাটাকাটি আছে আমাদের দুই জায়ের মধ্যে কিন্তু ওরা তো ভাই ভাই। অন্যদিকে তরিকের মা শফিকের সঙ্গে মিশতেই দিতে চায় না তরিককে। তরিককে বলেন, শফিকের কথা যে, ওই বান্দর ছ্যামরা তোকে খারাপ বানিয়ে ছাড়বে। ওর সঙ্গে মেশার দরকার নাই। তবু তরিক নাছোড়বান্দা শফিকের সঙ্গে না বেড়াতে পারছে ওর একটু ও ভালো লাগে না। দুজনে এক হতে দেখলে তরিকের মা চোখ মুখের বেহাল করে রাখে বিধায় শফিক আর তরিক দুজনে মিলে একটা সংকেত বানিয়েছে। যখনই কেউ ওটা দেবে কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে গিয়ে হাজির হবে। এমন করেই সংকেত দিয়ে দুই ভাই একসময় আজানের পর। তরিকের একটু ভয় বেশি। তাই তো কথা আছে, যে শফিক আগেভাগে রাস্তায় এসে তরিককে সংকেত দেবে, তখন তরিক বের হবে এবং দুজনে ওই মাঠের দিকে যাবে। বড়বাড়ির ঘেরের পাড়ের তালগাছ থেকে তাল কুড়াবে। বড় বড় তাল পড়ে। গ্রামের সবাই ওই বড় তালকে ধামা তাল বলেও থাকে। গ্রামের নাম করা তাল ওখানে। দেখলে যে কারোরই লোভ হবে সে তালের প্রতি। তাই তো ওই তাল কুড়ানো ভক্তের সংখ্যাও বেশি। এ ছাড়াও হিজলতলার ওখানেও বেশ কয়েকটি তালগাছ আছে। ওখানের তাল এত মিষ্টি যে চিনি-গুড় বাদেই শুধু তাল দিয়ে পিঠা, পাটিসাপটা বানালেও বেশ মজা হয়। তাল কুড়ানো শেষ হলে চারদিকে একটু আলো ফুটলেই কুমোরের বিলে নেমে হাঁটু পানি, মাজা পানি এমনকি গলা পানিতে নেমেও শাপলা তোলে ওরা দুই ভাই। কুমোরের বিলে পানি পানি আর পানি। শ্রাবণের বৃষ্টি পেলেই কুমোরের বিল শাপলা ফোটে। দুই ভাই শাপলা তুলে আঁটি বেঁধে কাঁধের ওপর দিয়ে আর দুই হাতে তাল নিয়ে ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফেরে।

তরিক ক্লাস ফোরে পড়ে। আর শফিক ফাইভে। ময়নামতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ওরা দুজনই। স্কুলে গিলেও ক্লাসের সময় বাদে অন্য সব সময় শফিক আর তরিক এক জায়গায় থাকে। পড়াশোনায় দুজনের কেউই তেমন ভালো না। দুজনেই একদম পেছনের বেঞ্চের ছাত্র না হলেও সামনের বেঞ্চের তো একদমই নয়। তরিকের মা সারাক্ষণ পাড়ায় ঘুরে বেড়ায়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই একবার সারা পাড়া ঘুরে না আসলে তার সকাল শুরুই হয় না। বড্ড আইনবাজ মহিলা। কিন্তু বাবা খুবই নরম স্বভাবের। সারা বছরই পরের ক্ষেতে কামলা খাটে। যদি কোনোদিন কারণবশত কাজে না যায় সেদিন সারাদিন তরিকের মা তরিকের বাবার সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ বাধায়। কামরা খাটা টাকা দিয়ে যদিও কিছু ছোট মাছ কিনে আনে, তরিকের মা সে মাছ কুটে না। ব্যাগ ধরে ফেলে দেয়। আর সকাল-বিকেল দুবেলা রান্না করে। তা প্রতি ওয়াক্তেই হয় এক পদের ভাজি নয়তো ভর্তা। তরকারি রাঁধবার মতো সময় তার হাতে নেই। খচ্চর টাইপের মহিলা। ছোট মানুষ, সখের বশেই হোক আর যে আনন্দ করেই হোক কত কষ্ট করে তাল কুড়িয়ে নিয়ে আসে। মাঠের পচা পানিতে নেমে শাপলা তুলে নিয়ে আসে। কিন্তুু একদিনও একটা তাল ছেনে পিঠা তো দূরের কথা একদিন জ্বালিয়েও দেয় না। তবু তরিক রোজ শফিকের সঙ্গে যায়। মাঝে মাঝে তরিকের খুব খারাপ লাগে তার মায়ের আচরণে। তবুও কিছু করার নেই। কিছু বললেই বাড়িতে থাকা খুব মুশকিল হয়ে যাবে। শফিকের মা তালের পিঠা বানালে শফিক তরিককে নিয়ে দেয়। তরিক চুরি করে খেয়ে তারপর বাড়ি যায়। কেননা, ওর মামা টের পেলে খবর আছে। বলে যে, পাড়ার মা-চাচিদেরটা খেয়ে বেড়াচ্ছিস। কেন, আমি তোকে কিছু তৈরি করে খাওয়াই না?

হঠাৎ একদিন নিম্নচাপ শুরু হলো। টানা তিন দিন বৃষ্টি। কেউই ঘর থেকে বের হতে পারে না। তিন দিনের মাথায় শফিক তরিকে সংকেত দিয়ে রাস্তায় এনে বলে সেদিন বিকেলে যে খবর পেয়েছে বৃষ্টি পেয়ে নাকি তাল পেকেছে খুব। পাকা তাল পড়ে পড়ে তালগাছের তলা বিছিয়ে থাকে। আবার মাঠও নাকি শাপলা ফুলে ভরে গেছে। কাল সকালে কিন্তু যেতেই হবে। খেলার মাঠ থেকে একটু ফিসফাস শুনে আসলাম। উত্তরপাড়ার মধুর ছেলে আর গোপালের ছেলেরা বলা-কওয়া করছে যে, কাল সকালে তাল কুড়াতে আর শাপলা তুলতে যাবে। আমরা কিন্তু ওদের আগে যাব। তা না হলে কিন্তু ভাগে পাব না। শফিক বলে আজানের আশায় বসে থাকলে চলবে না আজ। একটু আগে ভাগে যেতে হবে। শফিক বলে তুই জেগে রেডি হয়ে থাকবি, আমি রাস্তা থেকে সংকেত না দেওয়া পর্যন্ত বের হবি না।

সেদিন সারা রাতে একটুও ঘুমোতে পারেনি তরিক। ঘুমালেই স্বপ্ন দেখে শফিক সংকেত দিচ্ছে। কিন্তু কান খাড়া করে রাখে অনেক সময় কোনো সাড়া পায় না আবার। ঠিকই একসময় শফিক এসে সংকেত দেয় রাস্তায়। তরিক ঘরে চুরি চুরি করে বের হয়ে রওনা হয় দুই ভাই তাল কুড়াতে আর শাপলা তুলতে। চারদিকে বেদম অন্ধকার। শফিক বলছে আজান হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চল। আর তরিক বলে না ভাই এখনো আজান হয়নি। তরিক বলে আমি সারা রাত ঘুমোতে পারিনি। একটু ঘুমোলেই স্বপ্ন দেখছি যে তুই আমাকে সংকেত দিচ্ছিস। শফিক বলে একই অবস্থার শিকার আমিও হয়েছি। সারা রাতে তিন চারবার স্বপ্ন দেখেছি যে আজান হয়ে গেছে। চারদিকে আরো ফুটে গেছে, কিন্তু আমি আর তুই ঠিক টের পাইনি। পরে দুজনে তাল কুড়াতে গিয়ে কিছু পাচ্ছি না। দুজনে গল্প করতে করতে গিয়ে পৌঁছায় বড় বাড়ির ঘেরে। অনেক তাল পায় তাল তলাতে এবং শাপলা তোলে কুমোরের বিল থেকে। অন্যদিন শাপলার আঁটি পুরতে না পুরতেই সূর্য্য উঠে পড়ে কিন্তু সেদিন শাপলা তুলতে তুলতে হয়রান হয়ে পড়ে দুজনে কিন্তু সূর্য আর উঠে না। অবশেষে তরিক নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করে শফিককে। শফিক প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। মনে মনে ভাবে রাত কী তাহলে এখনো অনেক বাকি? একটা পাখি কুলিও তো ডাকছে না। শফিক বুঝতে পারে রাত এখনো অনেক বাকি। কিন্তু তরিককে বলে না। তরিক ভয় পেতে পারে সেটা ভেবে। দুজনে বাড়ি গিয়ে রওনা হয়। বাড়ি কাছাকাছি আসতেই কানে যায় হই...হুল্লো। তরিকের মায়ের কন্ঠ। তরিক কান খাড়া করে শোনে বলে, ভাই আজ বোধহয় আর আমাকে আস্ত রাখবে না। এমন সময় আজান কানে ভেসে আসে। শফিকের চোখ কপালে ওঠে। আর ভাবে তাহলে কোন সময় মাঠে গিয়েছিল দুজনে। মুহূর্তের মধ্যে শফিকের শরীর শিউরে ওঠে। শরীরের থেকে ঘাম বের হয়। ওদিকে তরিকের মায়ের আর্তনাদ শোনা যায়। শফিককেও শফিকের মাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে। আর বলছে যে ওই মিনশের ছেলে আমার ছেলেকে নিয়ে কোথায় মেরে ফেলেছে। তরিক শফিকের দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকায়। বড্ড অসহায় লাগছিল তরিককে। তার চেয়ে অসহায়ত্ব প্রকাশক চেহারা হয়েছিল সেদিন শফিকেরও। তরিক শফিকের চোখে চোখ রেখে বলে, কী করব। শফিক ইশারায় বলে বাড়ি যা। তরিক বাড়ি যায়। সব কিছু বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে কিন্তু তরিকের মা সবকিছু উল্টিয়ে দেয়। কী সব উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগে। সকাল হলেই তরিককে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দেয় দূরের এক খালার বাড়ি। শফিক বড় একা হয়ে যায়। প্রথমে শফিক ভেবেছিল হয়তো রাগে রাগে একটু বেড়াতে পাঠিয়ে দিয়েছে আবার বাড়ি ফিরবে। কিন্তু একদিন স্কুল থেকে শফিক শুনতে পারে তরিককে নাকি খালার বাড়ির ওখানের এক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। শফিকের চোখের সামনে তরিকের ভাই ডাকটা বারবার ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি বের হয়। শফিক প্রায়ই স্বপ্ন দেখে তরিককে। স্বপ্ন দেখে দুই ভাই আবার একসঙ্গে তাল কুড়াতে যাচ্ছে। শাপলা তুলছে। কিন্তু ঘুম থেকে জেগে দেখে সবই স্বপ্ন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist