আবদুস সালাম

  ২১ এপ্রিল, ২০১৮

বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের ইতিবৃত্ত

তোমরা অনেকেই জানো যে, প্রতি বছর ইংরেজি বর্ষের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। তোমরা কি জানো এই বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন আমাদের মাঝে কীভাবে প্রবর্তিত হয়েছে? হ্যাঁ, এখন তোমাদের সেই গল্পই বলব। সাথে সাথে তোমরা এও জেনে যাবে কীভাবে ইংরেজি সন থেকে বাংলা সন বা বাংলা সন থেকে ইংরেজি সনের দিন-তারিখ বের করতে হয়। তার আগে সন, তারিখ, খ্রিস্টাব্দ ও হিজরি সন বলতে কী বোঝায় সে বিষয়ে একটু ধারণা দিই। সন ও তারিখ দুটিই আরবি শব্দ। প্রথমটির অর্থ হলো বর্ষ বর্ষপঞ্জি এবং অন্যটির অর্থ দিন। সাল হচ্ছে একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ হলো বছর। খ্রিস্টাব্দ হলো যিশু খ্রিস্টের স্মরণে প্রবর্তিত একটি প্রতীকী অব্দ। সাধারণভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে যে, খ্রিস্টের জন্মগ্রহণের বছর থেকে এই অব্দের গণনা শুরু হয়েছে। হিজরি সন নবী করিম হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরতেরই স্মৃতিবহন করে আসছে। প্রিয়নবী (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মক্কা মোকাররামা থেকে মদিনার উদ্দেশে হিজরত করেন।

এবার আসি বঙ্গাব্দের বিষয়ে। তোমরা অনেকেই মুঘল সা¤্রাজ্যের তৃতীয় স¤্রাট আকবরের নাম শুনেছ। তার পুরো নাম জালালউদ্দিন মোহাম্মদ আকবর। পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আদিল শাহ শূরের সেনাপতি হিমুকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর শাসন করেছিলেন। তার সময়ে তারিখ গণনার জন্য হিজরি, শকাব্দি, ইংরেজি, বিক্রমাসম্ভাত সন এবং ভাস্করাব্দ মতো নানান সন চালু ছিল। স¤্রাট আকবরের আমলে সুবা-এ-বাংলা (বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা) মুঘল শাসনের আওতাভুক্ত হয়। তৎকালীন সময়ে প্রজাদের কাছ থেকে ফসলের মাধ্যমে খাজনা আদায় করা হতো। হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কৃষিপণ্য উৎপাদনের মৌসুম নিয়ে ঝামেলা হতো। আবার ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে একই সময় সব স্থানের কৃষকরা একই ফসল কাটতেন না। এর ফলে কৃষকরা অসময়ে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য হতেন। এ সমস্যার বিষয়টা পরিষ্কার হওয়ার জন্য তোমাদের জানতে হবে চান্দ্রবছর এবং সৌরবছর বলতে কী বোঝায়। হ্যাঁ, এবার সেটিই বলব। চন্দ্রের হিসাব অনুসারে এক বছর হয় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে আর সূর্যের হিসাব অনুসারে এক বছর হয় ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে। সৌরবছরের তুলনায় চান্দ্রবছর প্রায় ১১ দিন কম। অর্থাৎ প্রতি তিন বছরে এক মাসের হেরফের হয়। অথচ ফসল উৎপাদন করতে হলে কৃষকদের সৌরবছরের ওপর নির্ভর করতে হতো। এর ফলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এক জটিল সমস্যা দেখা দেয়। বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল স¤্রাট আকবর সৌরভিত্তিক সন প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন যেন কৃষকদের ফসল উৎপাদন ও খাজনা প্রদানে সহায়ক হয়। স¤্রাটের সভাসদের মধ্যে একজন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ ছিলেন তার নাম আমির ফতেউল্লাহ শিরাজী। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর সৌরভিত্তিক সন প্রচলনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি তাকেই দায়িত্ব অর্পণ করেন।

স¤্রাট আকবর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে এবং ৯৬৩ হিজরিতে সিংহাসনে বসেন। স¤্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের দিন তারিখ স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীর ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বরকে নতুন সন গণনার ভিত্তি হিসেবে ধরেন। নতুন বছর-গণন পদ্ধতির নাম দেন তারিখ-ই-ইলাহি বা ইলাহি সন। ফসলের মৌসুমের কথা বিবেচনায় রেখে এই নতুন সনের প্রবর্তন হয় বলে সেই সময় এটাকে ফসলি সন বলা হতো। সুবে বাংলায় খাজনা আদায়ের স্বার্থে মুঘলরা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ থেকে ইলাহি সন বা ফসলি সন চালু করেছিল। তারিখ-এ-ইলাহি এর পূর্বে বাঙালিরা শকাব্দ অনুযায়ী তারিখ গণনা করা হতো, যা বর্তমান ভারতের জাতীয় সন। শকাব্দির প্রথম মাস ছিল চৈত্র আর দ্বিতীয় মাস হলো বৈশাখ। ৯৬৩ হিজরির প্রথম মাস মহররমের সময়ে শকাব্দ সনের মাস ছিল বৈশাখ। হিজরি সনের সঙ্গে মিল করে তারিখ-এ-ইলাহির প্রথম মাস বৈশাখ ধরে গণনা করা হয়। অর্থাৎ ৯৬৩ হিজরির ১ মহররম তারিখ ছিল ৯৬৩ বাংলা সনের ১ বৈশাখ। হিজরি ৯৬৩ সনকে ইলাহি সনের প্রথম বৎসর ধরা হয়েছিল এবং এর পরবর্তী বৎসর থেকে সৌর বৎসর হিসাবে গণনা শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ফসলি সন নামে অভিহিত হতো। বাংলার জন্য উদ্ভাবিত বলে এটি পরবর্তী পর্যায়ে বাংলা সন নামে প্রচলিত হয়। পরবর্তী সময়ে যদিও ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ তারিখে তারিখ-এ-ইলাহি বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়েছিল, তবে এটি কার্যকর হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ হতে। তোমরা মনে রাখবে শূন্য (০) থেকে বাংলা সন গণনা করা হয়নি। ৯৬৩ বছর বয়স নিয়েই বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরু হয়। এর প্রথমাংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ বৎসর, সম্পূর্ণরূপে হিজরি সনভিত্তিক তথা চন্দ্র সন। পরবর্তী অংশ, অর্থাৎ ৯৬৩ থেকে অদ্যবধি, সৌরভিত্তিক। তোমাদের আরো একটা কথা বলে রাখি আর তা হলোÑবাংলা সনে আমরা বর্তমানে দিন ও মাসের যে নামগুলো ব্যবহার করি সেগুলো শকাব্দ থেকেই গৃহীত। সপ্তাহের নামগুলো রবি, সোম, মঙ্গল, বুধ ইত্যাদি গৃহীত হয়েছে গ্রহপুঞ্জ ও সূর্য থেকে। মাসের নামগুলো, যেমন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ ইত্যাদি আমরা পেয়েছি নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে।

তোমরা অনেকেই জানো যে, পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড লাগে। এই ঘাটতি দূর করার জন্য প্রতি চার বছর পরপর ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে একদিন যোগ করা হয়। এটাকে লিপইয়ার বা অধিবর্ষ বলা হয়। ইংরেজি সন বা খ্রিস্টাব্দে কোনো বছর অধিবর্ষ হবে কি নাÑতা মনে রাখার সহজ উপায় হলো সেই বছরটি যদি চার দ্বারা বিভাজ্য হয়, তাহলে জানতে হবে বছরটি অধিবর্ষ হবে। তখন ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গে এক দিন হয়ে তা ২৯ দিনে হবে। প্রতি ৪ বছরে এক দিন যোগ করার ফলে ৪০০ বছরে প্রায় ৩টি অতিরিক্ত দিনের সৃষ্টি হয়। তাই ৪টির মধ্যে কেবল একটি শতাব্দী বছর লিপইয়ার হিসেবে ধরা হয়। এ কারণে ১৭০০, ১৮০০ ও ১৯০০ সাল লিপইয়ার ছিল না এবং ২১০০ সাল লিপইয়ার হবে না। কিন্তু ১৬০০ এবং ২০০০ লিপইয়ার ছিল কারণ ওই বছরগুলো ৪০০ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজিত।

তাহলে তোমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে খ্রিস্টীয় সনের মতো বাংলা সনে শুরু থেকে লিপইয়ার বা অধিবর্ষের হিসাব করা হতো কিনা বা না হলে কবে থেকে হিসাব করা হয়েছে। হ্যাঁ, এবার সে বিষয়েই তোমাদের অবহিত করব। বঙ্গাব্দের যাত্রা শুরুর পর থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত খ্রিস্টীয় সনের মতো বাংলা সনে লিপইয়ার বা অধিবর্ষ ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি বঙ্গাব্দ সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটি চার বছর পরপর চৈত্র মাস ৩০ দিনের পরিবর্তে ৩১ দিনে গণনা করার পরামর্শ দেয়। বাংলা মাস গণনার সুবিধার্থে বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন হিসেবে এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত ৩০ দিন পরিগণিত হবে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক সংশোধিত বাংলা সন ১৯৮৮ সালের ১৯ জুন তারিখে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাংলা সন-এর সংশোধিত রূপ স্বীকৃত হয় এবং তখন থেকে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist