হাসান শান্তনু

  ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

ঢাকা-নেপিদো সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর

দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু

দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ

রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন ও পীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ। আগামী দুই মাসের মধ্যে শুরু হচ্ছে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার মিলে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে এ বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে ঢাকা ও নেপিদো। আনুষ্ঠানিক সমঝোতা স্বাক্ষর শেষে দুই দেশের পক্ষ থেকে এসব কথা বলা হয়েছে।

তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কত দিনের মধ্যে শেষ হবে, তার কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি সমঝোতায়। এমনকি চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি। মিয়ানমার সফররত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী দেশে ফিরে আগামীকাল শনিবার সমঝোতার বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়।

কূটনীতিকরা জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে একমত হয়েছে দুই পক্ষ। প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে দুই পক্ষ দফায় দফায় বৈঠক করেছে। এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর জোট আসেমের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দিতে এ সপ্তাহের শুরুতে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে যান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।

সমঝোতার পর গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটা প্রথম ধাপ। কীভাবে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা যায়, এখন সেই ধাপের কার্যক্রম শুরু হবে। আাগামী দুই মাসের মধ্যেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে, সে জন্য তো সময় দরকার।’ আরো বিস্তারিত তার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ঢাকায় ফিরে দুদিন পর এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে। এ সমঝোতাকে কূটনীতির ভাষায় ‘অ্যারেঞ্জমেন্ট অন রিটার্ন অব ডিসপ্লেসড পারসনস ফ্রম রাখাইন স্টেট’ বা ‘রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত মানুষদের ফিরিয়ে আনার সমঝোতা’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দুপুরে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চির কার্যালয়ে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ও মিয়ানমারের পক্ষে ইউনিয়ন মিনিস্টার ইউ চ্য তিন্ত সোয়ে সমঝোতা দলিলে সই করেন। এর আগে সু চির সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর বৈঠকে এ বিষয়ে দুপক্ষের সমঝোতা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াও মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। উভয় দেশের কর্মকর্তাদের কয়েক মাসের প্রয়াসের পর গতকাল মিয়ানমারের রাজধানীতে এ স্মারকের খসড়া প্রণীত হয়।

দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রায় ৪৫ মিনিটব্যাপী চলা এ বৈঠক ইতিবাচক হয় বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়। তবে এ বিষয়ে সর্তক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন কয়েকজন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ। সমঝোতা চুক্তির বিস্তারিত না দেখে তারা গণমাধ্যমের কাছে মতামত ব্যক্ত করতে রাজি হননি। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকায় রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তাড়াহুড়া করে সমঝোতা স্মারক চুক্তিতে আগ্রহী মিয়ানমার। দেশটির সঙ্গে রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়া ইস্যুতে অতীতের অভিজ্ঞতা সামনে রেখে বাংলাদেশ সমঝোতা করবে বলে তারা আশাবাদী।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১০ লাখের সবাইকে ফিরিয়ে নেওয়া, ফেরত পাঠানোর আগে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ে জাতিসংঘকে রাখা না-রাখা, রাখাইনে ফেরত পাঠানোর পর রোহিঙ্গাদের কোথায় রাখা হবে ইত্যাদি উল্লেখ আছে সমঝোতায়। এসবের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সময়সূচি ঠিক করে দিয়ে কাজ করা আর এ বিষয়ে দুই দেশ সমঝোতা স্মারক সই করলে প্রত্যাবাসন নিয়ে কোনো ধরনের জটিলতা দেখা দিলে তা নিয়ে তৃতীয় কোনো দেশের সহযোগিতা চাওয়া যাবে কি না ইত্যাদি আলোচনায় এসেছে।

এ ছাড়া এক বছরের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে সংযুক্ত করতে চেয়েছে ঢাকা। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ সময় গতকাল সকাল ১০টার কিছু আগে শুরু হয় মাহমুদ আলী-সু চি বৈঠক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সম্মতি জানালেও মৌলিক কিছু বিষয় তাদের মতপার্থক্য ছিল।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, মাহমুদ আলী ও তিন্ত সোয়ে ১৯৯৮ সালে সম্পন্ন নাফ নদীর উত্তরে স্থল সীমান্ত চিহ্নিতকরণ চুক্তির অনুসমর্থন দলিলও বিনিময় করেন। উভয় পক্ষের মধ্যে এর আগে ২০০৭ সালে নাফ নদীতে সীমানা নির্ধারণ-সম্পর্কিত সমঝোতার বিষয়ে সম্পূরক প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়।

সমঝোতার বিষয়ে মিয়ানমারের সরকারের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঘটবে তাদের পরিচয় যথাযথভাবে যাচাই করার পর। এতে দাবি করা হয়, ১৯৯২ সালে দুই দেশের তরফে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়, তার মধ্যে এই বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও নীতিমালা ছিল। রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিকীকরণের বিরোধিতা করে মিয়ানমারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সমস্যা শান্তিপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুই দেশের মধ্যে সর্বশেষ সমঝোতাকে ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ বা ‘দুই পক্ষের জন্য বিজয়’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্র জানায়, রাখাইনে গত ২৫ আগস্ট তল্লাশিচৌকিতে সন্ত্রাসী হামলার জেরে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর নৃশংসতা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় লাখ ২২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে থেকে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে আরো কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস করছে। তাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের আহ্বানে আন্তর্জাতিক বিশ্ব মিয়ানমারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist