কূটনৈতিক প্রতিবেদক

  ২২ জুলাই, ২০১৮

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্যানেল গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে

এবার সরে দাঁড়ালেন থাই কূটনীতিক

গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে রাখাইন সংকট নিরসনে গঠিত মিয়ানমার সরকারের আন্তর্জাতিক প্যানেলÑ ‘কমিটি ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য রিকোমেনডেশন অন রাখাইন স্টেট।’ রাখাইন পরিস্থিতির তদন্ত শেষে কফি আনান কমিশনের পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছিল, তা বাস্তবায়নের স্বার্থেই ওই আন্তর্জাতিক প্যানেলটি গঠন করা হয়েছিল। তবে শুরুতেই পাঁচ সদস্যের প্যানেল থেকে মার্কিন রাজনীতিবিদ বিল রিচার্ডসন পদত্যাগ করলে এর ভবিষ্যৎ সংশয়ের মুখে পড়েছে। এবার প্যানেলটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করা সাবেক থাই কূটনীতিক কবসাক চুটিকুলও পদত্যাগ করেছেন। জানা গেছে, কমিটির বিদেশি সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজের সুযোগও দিচ্ছে না মিয়ানমার। সবমিলে থমকে দাঁড়িয়েছে প্যানেলটির কার্যকারিতা। এই কমিটি আসলে এখন অকেজো হয়ে পড়েছে।

২০১৬ সালে ডি ফ্যাকটো সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের সময়ই অং সান সু চি জানতেন রাখাইন তার জন্য বড় রাজনৈতিক বাধা হয়ে উঠবে। আর সে কারণে দায়িত্ব নেওয়ার দ্বিতীয় মাসেই সু চি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাখাইন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সুপারিশ তৈরির জন্য একটি কমিশনের নেতৃত্ব দিতে তিনি আনানকে অনুরোধ জানান। ২০১৬ সালের জুনে মিয়ানমারে সফর করে কফি আনান ফাউন্ডেশন। সেসময় সু চির অনুরোধে সাড়া দেন আনান। গত বছরের ২৪ আগস্ট কমিশনের কার্যকাল শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

রাখাইন সংকট নিরসনে ৮৮টি সুপারিশ হাজির করা হয় আনান কমিশনের পক্ষ থেকে। সেইসব সুপারিশ বাস্তবায়নে পরামর্শ দেওয়ার জন্যই ‘কমিটি ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য রিকোমেনডেশন অন রাখাইন স্টেট’ নামের আন্তর্জাতিক প্যানেলটি গঠন করেছিল মিয়ানমার সরকার। গত বছর মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি এই প্যানেলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন থাইল্যান্ডের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুরাকিয়ার্ত সাথিরাথাইকে। প্যানেলের পাঁচজন আন্তর্জাতিক সদস্যের একজন ছিলেন প্রবীণ মার্কিন রাজনীতিবিদ বিল রিচার্ডসন। জানুয়ারিতে প্যানেলের প্রথম বৈঠকেই তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। প্যানেলকে ‘হোয়াইটওয়াশ’ ও মিয়ানমারের নেত্রী সু চির ‘গুণকীর্তনের অভিযান’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি। একসময়ের ঘনিষ্ঠ সু চির নৈতিক নেতৃত্বের ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিল রিচার্ডসন। বিলের পদত্যাগের সময় সু চির কার্যালয় পাল্টা অভিযোগ করে বলেছিল, রিচার্ডসন নিজের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন এবং প্যানেল থেকে তাকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। তবে গতকাল শনিবার এক প্রতিবেদনে এই প্যানেল সংশ্লিষ্ট আরেক ব্যক্তির পদত্যাগের খবর মিলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্যানেলের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালনকরা সাবেক থাই কূটনীতিক ও পার্লামেন্ট সদস্য কবসাক চুটিকুল পদত্যাগ করেছেন। প্যানেলের কমিটির সদস্য না হলেও কবসাক ছিলেন বৈঠক আয়োজন, তথ্য সংগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছ থেকে মত সংগ্রহ করার দায়িত্বে। তার পদত্যাগের বিষয়ে চেয়ারম্যানের কোনো মন্তব্য এখনো জানা যায়নি।

পদত্যাগের পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনের বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের অবস্থানের কথা তুলে ধরে কবসাক বলেন, পরিস্থিতিকে তারা সব সময়েই অভ্যন্তরীণ বিষয় আখ্যা দিতে চায়, সবসময় তারা এটাই করে আসছে। তারা দাবি করছে তারা কোনো ভুল কিছু করেনি। নিপীড়নের যেসব কথা প্রকাশিত হচ্ছে তা ভুল প্রচারণা। কবসাক জানান, প্যানেলটিকে আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি স্থায়ী কার্যালয় স্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। কমিটিকে বলা হয়েছে অনলাইনে বৈঠক করার জন্য। সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিরা প্যানেলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বলেন দেখি তারা কী করছে? নেপিদোতে তারা সুস্বাদু নৈশভোজ করছেন এবং ঘুরে দেখছেন। আশঙ্কার কথা হলো এখন ইস্যুটি থেকে মনোযোগ সরানো হচ্ছে। এমন একটা প্রচারণা চালানো হচ্ছে যেন, অনেক কাজ হচ্ছে।

এ প্রতিবেদনে প্যানেলটির সর্বশেষ বৈঠকের কথা তুলে ধরা হয়েছে। ওই বৈঠকের দুজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বৈঠকে প্যানেলের আন্তর্জাতিক সদস্য সুইডিশ রাজনীতিক আরবান আহলিন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সু চির কার্যালয়ের একজন মন্ত্রী কিয়াউ টিন্ট সোয়ে তাকে থামিয়ে দেন। এই বিষয়ে গণমাধ্যমের আহলিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। প্যানেল চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। বৈঠকে উপস্থিত মিয়ানমারের সরকারের কর্মকর্তারাও মন্তব্য চেয়ে পাঠানো ইমেইলের কোনো জবাব দেননি।

সংঘাত-সহিংসতাপূর্ণ রাখাইনের সংকট সমাধানে প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়টির আলোচনাতেও এটা গুরুত্ব পাচ্ছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না এবং দেশটিতে অবাধ চলাফেরার অধিকার নেই তাদের। মিয়ানমার সরকারের দাবি তারা আনান কমিশনের বেশির ভাগ সুপারিশ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু জুন মাসে মিয়ানমার সরকারের এক সিনিয়র কর্মকর্তা পশ্চিমা কূটনীতিক ও আনান কমিশনের সদস্যদের কাছে বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন পর্যালোচনা সম্ভব না। অর্থাৎ সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না।

পদত্যাগের পর কবসাক জানান, আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নির্ভর করবে মিয়ানমারে নিযুক্ত জাতিসংঘের নতুন দূতের ওপরই। জাতিসংঘ জুনে সুইডিশ কূটনীতিক ক্রিস্টিন বার্গেনারকে মিয়ানমারে নিয়োগ দিয়েছে। জুনেই প্রথম সফরে ক্রিস্টিন মিয়ানমারের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

এর আগে জুলাই মাসে নতুন এক প্রতিবেদনে রাখাইনে নিজেদের কাজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছে আনান কমিশন। ৮ জুন ‘সঞ্চিত অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। নতুন প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, কমিশন গঠনের পর থেকেই মিয়ানমারের বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে বাধা আসতে শুরু করে। সেনাপ্রধান কমিশনকে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেও শেষ পর্যন্ত কমিশনটি বিলোপ করার নানা রকম চেষ্টা করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এর যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিপুল পরিমাণ শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিতে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি করতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে রোহিঙ্গা সংকট পর্যবেক্ষণে সাত দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারে মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি বলেছেন, ‘যেহেতু এটি পরিষ্কার যে মিয়ানমার সরকার কার্যত কোনো অগ্রগতিই অর্জন করেনি অর্থাৎ, রোহিঙ্গাদের বঞ্চিত করার আইন, নীতি ও প্রথার বিলুপ্তিতে এবং দক্ষিণ রাখাইনকে নিরাপদ করে তুলতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, সেহেতু নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist