প্রতীক ইজাজ

  ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

রোহিঙ্গাদের কারণে সংকট বাড়ছে

কত চাপ সামলাবে বাংলাদেশ

* বর্ষায় সুরক্ষা দিতে নতুন করে পাহাড় কেটে আশ্রয় শিবির করা হচ্ছে

প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। শুরু থেকেই জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে নিরাপদে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু গত আট মাসে একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি দেশটি। উল্টো ফিরিয়ে না নিতে নানা টালবাহানা করছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু হবে তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ। গত ২৫ আগস্ট থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা। নতুন আর পুরনো মিলে বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস।

এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এই বিশাল চাপ সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে আসন্ন বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও সম্ভাব্য পাহাড়ধস থেকে এসব রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে নতুন চাপের মুখে দেশ। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা। এসব রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় শিবির নির্মাণ করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে পাহাড় কাটতে হচ্ছে। বনভূমি উজাড় হচ্ছে। ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি কড়া প্রহরার মধ্যেও কাজের খোঁজে দেশের বিভিন্ন স্থানে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। ঝুঁকির শঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার। এমনকি এসব রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসাসহ নানা প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মিয়ানমারকে নানা চাপের মুখে রেখেছে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। গতকালও বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোহিঙ্গারা যাতে স্বেচ্ছায় নিরাপদে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সেই লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন। এই প্রতিনিধি দল আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার জন্য দুই দিনের সফরে মিয়ানমার যাবেন। এর আগে গত শনিবার অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুলও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য রোহিঙ্গা শরণার্থীর এই বিশাল চাপের কারণে দেশে দীর্ঘমেয়াদি বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়কে বড় করে দেখছেন। তারা মোটা দাগে তিন ধরনের সমস্যার আশঙ্কা করছেন। এগুলো হলো জাতীয় বা সামষ্টিক অর্থনীতি, সামাজিক ও পরিবেশ এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। তারা পরামর্শ দিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হতে পারে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও রোহিঙ্গা গবেষক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, এরই মধ্যে নানা প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে এসব শরণার্থীর আশ্রয়, খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর প্রচন্ড চাপ পড়বে। সামাজিক পরিবেশ ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন তারা। বিশেষ করে কেবল কক্সবাজার এলাকাতেই এসব শরণার্থী আশ্রয় নেওয়ায় সেখানকার পরিবেশে নানা ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভোগ্যপণ্য ও কর্মক্ষেত্রে নতুন চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি এসব শরণার্থী দেশের জনমিতির ওপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা কোনো ধরনের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারায় বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের মাথাপিছু আয়েও।

এই গবেষক আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি, সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ এত চাপ নিতে প্রস্তুত নয়। ফলে সরকারকে খুব সতর্কতার সঙ্গে এ ইস্যুকে মোকাবিলা করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে।

বর্ষা মৌসুম ঘনিয়ে আসায় ভূমিধস, সাইক্লোন, অতিবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা বেড়েছে। আতঙ্কে আছে রোহিঙ্গারাও। পাহাড়ের ওপরে ত্রিপলের ছাউনি ও বাঁশ-পলিথিনে ঘেরা ঘরগুলো নিরাপদ নয়। ফলে পরিবার-পরিজনসহ ঝড়বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ে উৎকণ্ঠা এবং দুশ্চিন্তায় আছে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবার। জাতিসংঘের এক তথ্য মতে, অন্তত দেড় লাখ রোহিঙ্গা আসন্ন বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় পাহাড় কেটে, নিচু জায়গা ভরাট করে, নতুন করে বনভূমি এলাকা বরাদ্দ দিয়ে রোহিঙ্গাদের রাখার জায়গা করা হচ্ছে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে দিয়ে ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃতির, পরিবেশের।

এশীয় দুর্যোগ প্রস্তুতিমূলক কেন্দ্র (এডিপিসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পাহাড়ি ঢল ও ভূমিধসের কারণে ১ লাখ রোহিঙ্গার চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ওই সমীক্ষার পর চরম ঝুঁকিতে থাকা অন্তত ২৫ হাজার রোহিঙ্গার আবাসনের জন্য পাহাড় কাটতে হয়েছে। এছাড়া কুতুপালং-বালুখালী শিবির এলাকা সম্প্রসারণের জন্য প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ করা জমির পরিমাণ ২ হাজার একর থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার একর করা হয়েছে। এছাড়া শুরুতে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৪ হাজার ঘর তৈরির কথা থাকলেও পরে ঘরের সংখ্যা ২ লাখ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান জানান, উখিয়ায় আগে ২০টি শিবির ছিল। বর্তমানে বাড়িয়ে ৩০টি করা হয়েছে। কুতুপালং থেকে থাইংখালী পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহদায়তন এলাকায় আছে এসব শিবির। বন বিভাগ এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য ৫ হাজার ৮০০ একর বনভূমি বরাদ্দ দিয়েছে।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার আট মাসের মাথায় এসে এসব রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ জোগাড় করা কঠিন হবে বলে মনে করছে জাতিসংঘ। গত মার্চে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সিপ্পো বলেন, যে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু ছিল সেটি ফেব্রুয়ারি শেষ হয়েছে। নতুন এ যৌথ পরিকল্পনা চলতি বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। নতুন অর্থ জোগাড় করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে হচ্ছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, খাদ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্যান্য সহায়তাও দিয়ে আসছিল। কিন্তু এখন নতুন করে আরো অর্থ প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় ৮০০০ কোটি টাকার ২৫ শতাংশ খরচ হবে স্থানীয় বাংলাদেশীদের জন্য, যাদের বসবাস শরণার্থী ক্যাম্পের আশপাশে। তার হিসাবে, দেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য আগামী ১০ মাসে ৯৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ৮০০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে থেকে এই অর্থ জোগাড়ের আশায় জাতিসংঘ জেনেভাতে একটি বৈঠকও করেছে।

দেশের অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রাক্কলন অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১৬০২ মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে পুরনো রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু আয় হওয়ার কথা ১১২ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কিন্তু শরণার্থী রোহিঙ্গাদের আয়ের কোনো উৎস নেই। এদেশের মানুষের মাথাপিছু ব্যয় প্রায় ৭০০ ডলার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ব্যয় থাকলেও বৈধপথে আয়ের কোনো উৎস নেই। সেই হিসাবে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হবে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। যা অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

রোহিঙ্গাদের এই চাপের কারণে সামাজিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ায় কক্সবাজারসহ ওই এলাকার পর্যটন, অর্থনীতি ও পরিবেশ ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে গাছপালা ও পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে, শরণার্থীরা খোলা আকাশের নিচে মলমূত্র ত্যাগ করায় ওই এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

এই পরিবেশবিদ আরো বলেন, বর্তমানে কক্সবাজারে চারজন বাংলাদেশি নাগরিকের বিপরীতে একজন রোহিঙ্গা বসবাস করছেন। পাহাড় বা বনভূমির বড় একটা অংশ দখল করে আছে এসব রোহিঙ্গা। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি জীবিকার অন্বেষণে বনের কাঠ বিক্রি, মৎস্য আহরণ করছে এসব নাগরিক। যেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে সাগর-নদীতে মৎস্য আহরণের পথ দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ জীবিকার টানে জেলের পেশা বেছে নিয়েছে; ঢুকে পড়েছে গণপরিবহন খাতেও। এতে সরাসরি অর্থনৈতিক খাতে ভাগ বসাচ্ছে তারা। আবার যে পরিবেশে তারা আছেন, সেখানে পর্যাপ্ত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় ঝুঁকি বাড়ছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist