মোসা. তামিম তুলি
মুক্তমত
উন্নত জাতি গঠনে শিশুশ্রম নিরসনের বিকল্প নেই
শিশুশ্রম বলতে আমরা বুঝি শিশু তার শৈশবের আনন্দঘন পরিবেশে খেলাধুলা না করে, তার অপার সম্ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে, শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের মাধ্যমে যদি অর্থ উপার্জন করে। কথায় আছে, ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ অর্থাৎ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু শিশুশ্রম রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হওয়ায় বর্তমানে এই কথাটির মর্মার্থ সংকোচিত হয়ে পড়েছে। উন্নত জাতি গঠনের মৌলিক কারণগুলোর মধ্যে শিশুশ্রম একটি। অশিক্ষা, দরিদ্রতা, অসচেতনতা দূর করে ও প্রয়োজনীয় সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে শিশুশ্রম নিরসন করতে পারলে উন্নত জাতি গঠন সম্ভব হবে।
শিশুশ্রম একটি সহজলভ্য ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, যার প্রভাব শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়। শিশু বলতে সাধারণত ১৪ বছরের নিচে সবাইকে বোঝায়। শিশুরা খেলাধুলা করবে, দুষ্টুমি করবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শিশুশ্রমে নিযুক্ত হয়ে বহু শিশু শৈশবেই অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অবকাঠামো গত উন্নয়ন হচ্ছে এবং আমরা অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ গঠনের স্বপ্ন দেখছি, কিন্তু শিশুশ্রম নিরসনে আমরা অনেক পিছিয়ে। কারণ শতকরা ৯৩ ভাগ শিশু অনানুষ্ঠানিক খাতে যেমন ছোট কারখানা ও কর্মশালা, রাস্তায়, গৃহভিত্তিক ব্যবসা ও গার্হস্থ্য কর্মসংস্থানে নিযুক্ত। এভাবে শিশু বয়সেই শ্রমে যুক্ত হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে দেশে সাক্ষরতার হার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে এবং দেশ উন্নতির পথে পিছিয়ে যাচ্ছে।
২০০৬ সালে বাংলাদেশে শিশু আইন ও জাতীয় শ্রম আইন গঠন করা হয়। শ্রম আইন অনুযায়ী চাকরির ন্যূনতম আইনি বয়স ১৪ বছর করা হয় এবং জাতীয় শিশু আইন অনুযায়ী ১৪ বছরের কমবয়সি শিশুদের মজুরির বিনিময়ে কর্মে নিয়োজিত করা অপরাধ বলে গণ্য হবে। তার পরও দেশে ৫-১৪ বছর বয়সি ৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশুদের জোরপূর্বক কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব শিশুদের শতকরা ৮৩ জন গ্রামাঞ্চলে এবং ১৭ জনকে শহরাঞ্চলে নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শিশুশ্রম জরিপের তথ্য মতে, ২০২৩ সালে দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ছিল, যা ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে ৩৪ লাখ ৫০ হাজার ছিল অর্থাৎ ১০ বছরে প্রায় এক লাখ শিশু শ্রমিক বেড়েছে। ফলে শিক্ষা থেকে পিছিয়ে এই শিশুগুলো উন্নত মানবসম্পদে পরিণত হতে পারেনি। উন্নত মানবসম্পদ ছাড়া উন্নত জাতি গঠন নিছক স্বপ্নমাত্র। তাই শিশুশ্রম ও এর ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং শিশুশ্রম নিরসনের চেষ্টা করতে হবে।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। বহু পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। সন্তানদের ভালোভাবে পড়াশোনা করানো বা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা এই দারিদ্র্য পরিবারের জন্য অসম্ভব। দরিদ্র পরিবারের এই শিশুগুলো নিজেদের মৌলিক চাহিদা বা দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের তাগিদে কর্মে নিযুক্ত হয়। শিশু বয়সেই কাঁধে তুলে নেয় নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব। এর ফলে দেশের একটা বিশাল অংশ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, যা উন্নত দেশ ও জাতি গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠু বিচক্ষণতার অভাবে শিশুশ্রম নিরসন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একটি সুস্থ সুন্দর রাষ্ট্র, আদর্শ ও উন্নত জাতি গঠনে শিশুশ্রম নিরসন করে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিশুশ্রম নিরসন করতে পারলে তবেই আজকের শিশু আগামীতে উন্নত রাষ্ট্র ও জাতি গঠন করতে সক্ষম হবে।
শিশুশ্রম নিরসনের জন্য ২০০৬ সালে প্রণীত জাতীয় শিশু আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হলেও তা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। কিছু দুষ্টু মানুষ প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে শিশুদের কর্মে নিয়োগ দেয় বেশি। এর মূল কারণ হলো শিশুদের দিয়ে কম পারিশ্রমিকে বেশি কাজ আদায় করা যায়। এতে তারা লাভবান হয় বেশি কিন্তু শিশুর জন্য এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। জাতীয় শিশু আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি ১৪ বছরের শিশুকে কর্মে নিযুক্ত করলে তার জরিমানা ও সাজা হবে, কিন্তু এই আইন পুরোপুরি কার্যকর করতে আমরা ব্যর্থ। বর্তমানে শ্রমের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে শিশুদের দুরন্ত শৈশব এবং সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অন্ধকারের গভীর অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা ৪৫ শতাংশ শিশু। ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে শিশুর সংখ্যা ৬ কোটিরও বেশি। এদিকে শ্রম অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৬৯ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে। ৯০ শতাংশ শিশু প্রাথমিকভাবে বিদ্যালয়ে গেলেও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই অর্ধেকের বেশি শিশু ঝরে পড়ে। এভাবে শিশুশ্রমের কারণে দেশে শিক্ষিতের হার হ্রাস পাচ্ছে এবং অশিক্ষার কারণে শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্র ও জাতির উন্নতি সাধনে শিশুশ্রম নিরসনের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ ও সহযোগী সদস্য, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি
"