মোজাম্মেল হক
মুক্তমত
বাংলার শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলিম শাসকদের অবদান
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড ছাড়া যেমন কোনো প্রাণী দাঁড়াতে পারে না, তেমনি শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারে না। একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থায় আদর্শ সমাজ গঠনে সাহায্য করে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাত ধরে অসংখ্য মুসলিম শাসক ভারতীয় উপমহাদেশে আগমন করেন। মুসলিমদের আগমনের পূর্বে ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল খুবই করুণ অবস্থা। ছিল না শিক্ষা অর্জনের জন্য ভালো কোনো পরিবেশ। বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও তার সংখ্যা ছিল অতিনগণ্য। তবে সেখানেও নিম্নশ্রেণির মানুষের সন্তানরা পড়ার সুযোগ পেত না। মুসলমানদের আগমনের ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হয়। প্রত্যেকটি অঞ্চলে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
প্রকৃতপক্ষে মুসলমানদের বাংলায় আগমন ছিল শিক্ষা ও সভ্যতার আগমন। বাংলায় মুসলিমরা একটি সভ্য জাতি গঠনে শিক্ষার প্রসারের জন্য অসংখ্য অগণিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ইংরেজ আমলে বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা তদন্তের পর ডব্লিউ এডাম তার রিপোর্টে (এডুকেশন রিপোর্ট কলকাতা) উল্লেখ করেন, ‘চার কোটি ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক লাখ প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। যেখানে ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের ৩০০ ছেলেমেয়ের জন্য অন্তত একটি বিদ্যালয় ছিল।’
মুসলিম শাসন আমলে প্রতিটি শিশু চার বছর চার মাস চার দিন বয়সে উপনীত হলে তাকে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত করে পরিবারের সব সদস্য ও অন্য স্বজনদের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাথমিক জ্ঞান প্রদানের সূচনা করা হতো।
আমরা আধুনিক যুগে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চতর যে তিনটি স্তর দেখতে পায় তা মূলত মুসলিম শাসকরা চালু করেন। সুলতানি আমলে বাংলার প্রধান প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল মসজিদসংলগ্ন মক্তব ও মন্দির। মুসলিম শিক্ষার্থীদের মক্তবে এবং হিন্দু শিক্ষার্থীদের মন্দিরে শিক্ষা দেওয়া হতো। শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত তার বিক্রমপুরের ইতিহাস নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে মক্তব বা পাঠশালা একই চালার নিচে একত্রে বসত। সেখানে মুনশি (মুসলিম শিক্ষক) ভোরে শিক্ষাদান করতেন এবং পণ্ডিত (হিন্দুগুরু) বিকেলে ছাত্রদের শিক্ষাদান করতেন’। এ ছাড়া অভিভাবক বা শিক্ষকের গৃহে, পথিকের বিশ্রামাগারে, দোকানের কোণে কিংবা গাছের নিচেও শিক্ষাপ্রদান করা হতো। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক জ্ঞান শিক্ষাদানের পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা দান করা হতো।
প্রাথমিক শিক্ষা শেষে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা প্রদান নিশ্চিত করতে মুসলিম শাসকরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। গড়ে তোলেন অসংখ্য স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আইনি আকবরী গ্রন্থের লেখক আবুল ফজল মুসলিম যুগে ভারতের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার উন্নতি সম্বন্ধে মন্তব্য করে বলেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই যুবকদের শিক্ষার জন্য স্কুল রয়েছে, কিন্তু হিন্দুস্তান বিশেষভাবে তার বিদ্যালয়ের জন্য বিখ্যাত।’ মুসলমানদের এসব অবদান সম্পর্কে ব্রিটিশ লেখক এমএনল তার ‘প্রমোশন অব ডিউরিং মহম্মদ রুল’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘মুসলমানদের ভারত আক্রমণ শুধু রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যাপারে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শিক্ষা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রেও যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেছিল।’
যখন নিম্ন শ্রেণির মানুষের শিক্ষার কোনো সুযোগই ছিল না তখন মুসলিমরাই শিক্ষাকে একটি অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। মুসলিম শাসকরা নিম্ন শ্রেণির এবং গ্রাম্য অঞ্চলের শিক্ষার ব্যাপারে খুবই যত্নশীল ছিল। সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল এবং তার ফলে সাধারণ মানুষরাও পড়ালেখার যোগ্যতা অর্জন করেছিল। ‘মানিকচন্দ্র রাজার গান’ নামক কাব্য গ্রন্থ থেকে জানা যায় হিন্দু সমাজের ‘হাড়ি’ ও সাহুরারাও (সাহা) দলিলপত্র পড়া ও লেখার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন।
বাংলার মুসলিম শাসকরা কখনো বাংলা ভাষাকে (পাকিস্তানিরা ছাড়া) অবজ্ঞার চোখে দেখেননি। বাংলা ভাষাকে তারা খুবই শ্রদ্ধা করত। অসংখ্য শাসক বাংলা ভাষায় শিক্ষা অর্জন করেছেন। বিশিষ্ট লেখক মো. আবদুল্লাহ আল-মাসুম ‘ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিম শিক্ষা, সমস্যা ও প্রসার’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলা বহু মুসলমানদের মাতৃভাষা ছিল বলে বাঙালি মুসলমানরা মাতৃভাষাকে অবহেলা করতে পারিনি। বহিরাগত মুসলমানরাও বাংলা ভাষা ও এ দেশকে নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।’
শিক্ষা সম্প্রসারণে মুসলিম শাসকরা বই-পুস্তক প্রকাশিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদানের প্রশংসা করে যদুনাথ সরকার বলেন, ‘যখন প্রথম যুগের হিন্দু লেখকরা সাধারণ রীতি অনুসারে তাদের রচিত পুস্তকাদি গোপন রাখতে পছন্দ করতেন, সেই যুগে পুস্তক নকল করার এবং তা প্রচারের দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রথা প্রচলনের জন্য আমরা মুসলমানদের কাছে ঋণী’।
মুসলিমরা শিক্ষার আধুনিকায়ন করার জন্য মনীষীদের গবেষণায় তৎপর রাখতেন। মুসলমানদের শিক্ষা সম্বন্ধে এইচ জি রলিনসন তার ‘এ শর্ট ক্যালচারাল হিস্টোরি’ গ্রন্থে লিখেছেন, মুঘল ভারতের শিক্ষা সংস্কৃতি আধুনিক যুগের উত্তম শিক্ষা পদ্ধতিরই ফলশ্রুতি।
সর্বোপরি, মুসলমান শাসন আমলে বাঙালি সমাজের সর্বস্তরে শিক্ষার প্রসার ঘটে। শিক্ষা ও জ্ঞান নানাভাবে বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনকে উন্নত করে তোলে। ফলে দেশে এক অভূতপূর্ব আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ দেখা দেয়।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
"