মো. সাব্বির হোসেন রানা

  ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

তাপপ্রবাহ মোকাবিলা ও পরিকল্পিত গাছ রোপণ

বদলেছে মানুষ, বদলেছে পৃথিবী, বদলেছে জলবায়ু। পরিবর্তনের এ অবিরাম যাত্রায় একবিংশ শতাব্দীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব। যেখানে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বিগত দুই দশকের জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে লক্ষ করলেই আসন্ন সংকটের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে। বইয়ে পড়া ‘সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির শব্দ, সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁর গান, পাকা ধানের মণ্ডম ঘ্রাণ’- এসবই পাবেন একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে। কিন্তু মাত্র কয়েক দশক পেরিয়ে এগুলো সবই প্রায় আমরা হারিয়েছি।

টানা কয়েক দিনের প্রচণ্ড গরমে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। এ অবস্থায় প্রচণ্ড গরমে নাকাল হয়ে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন। শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে। গরমে গলে যাচ্ছে শহরের বেশ পিচঢালা সড়ক। এরই মধ্যে প্রকট রোদ উপেক্ষা করেই যাত্রী বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন রিকশাচালকরা। সূর্যের তাপ এতই বেশি যে, খোলা আকাশের নিচে হাঁটলেও গরম বাতাস লাগছে চোখে-মুখে। যাত্রাপথে ছাতা মাথায় দিয়ে তাপ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন অনেকেই। স্বস্তি পেতে শ্রমজীবী মানুষ রাস্তার পাশে জিরিয়ে নিচ্ছেন, আবার কেউ কেউ হাতে-মুখে পানি দিয়ে ঠাণ্ডা হওয়ার চেষ্টা করছেন। আর শিশু-কিশোররা গরম থেকে রেহাই পেতে মাতছে জলকেলিতে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষ বার্তা : সতর্কতা থাকতে সারা দেশে হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অফিস। শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) যশোরে তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এদিন চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত শনিবার যশোরে তাপমাত্রা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

তারা আরো জানিয়েছেন, এ তাপদাহ আরো কিছুদিন বিরাজ করবে। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় অস্বস্তি বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই এপ্রিল মাসে গড়ে সাধারণত দু-তিনটি মৃধু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ ও এক-দুটি তীব্র থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে আরো জানা যায়, গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ০.৫ শতাংশ। এমনকি ২০৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ২.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে প্রভাব : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়েছে চরমভাবে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসকরণ’-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়-সংক্রান্ত ঝুঁকির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে শীর্ষে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় একটি বলিষ্ঠ অভিযোজন পরিকাঠামো গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

এ ছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতার ঝুঁকিতে থাকা অন্যতম তিনটি ক্যাটাগরিতে ১২টি দেশের তালিকায় বন্যায় প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ, ঝড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ প্রথমে রয়েছে ফিলিপাইন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে দশম অবস্থানে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশে যে বিবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং ইতিমধ্যে পড়েছে তার মধ্যে রয়েছে বৃষ্টিপাত হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অতিঝড়, ভূমিকম্পসহ নানা দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।

দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের করণীয় : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার পাশাপাশি বন উজাড় ও বৃক্ষনিধন রোধ, কার্বন নিঃসরণ রোধ, শিল্পদূষণ রোধ, পরিবেশদূষণ রোধে কার্যকর আইনপ্রণয়ন ও প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। তা ছাড়া জনসেচতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পরিবেশ দূষণরোধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি।

এই তাপদাহ কিংবা রোদের প্রখরতা কমাতে আমাদের নিয়মিত সবাইকে গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে বেশি বেশি গাছ রোপণ করা। বিভিন্ন সংগঠন বছরব্যাপী চেষ্টা করে গাছ রোপণের। তবে করোনা মহামারি যেভাবে ভাইরাসের মতো দেশকে আক্রান্ত করেছে, ঠিক সেভাবে গাছ রোপণ করে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে যদি আক্রান্ত করা যেত, তবে দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপ মোকাবিলা করতে পারত। এর মাধ্যমে অতি তাপমাত্রাসহ বিভিন্ন দুর্যোগ লাঘব হবে বলে মনে করি।

দেশের বনভূমির অবস্থা : একটি দেশের আয়তন অনুযায়ী ওই দেশের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন সেখানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী একটি প্রতিবেদনে দেশের আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে বলে জানান।

পরিবেশমন্ত্রী আরো জানান, সরকারের এসডিজি এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২৫) বাস্তবায়নে বন অধিদপ্তর থেকে দেশব্যাপী বনাচ্ছাদন ও বৃক্ষাচ্ছাদনের পরিমাণ ২০২৫ সালের মধ্যে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ২ ও ২৪ শতাংশে উন্নীত করা হবে।

তাহলে আমরা বুঝতে পারি কত পরিমাণ বৃক্ষ আমাদের রোপণ করা অতিব জরুরি। তবে এই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় যদি না জনগণ সহযোগিতা না করে। এ জন্য সবাইকে নিজ নিজ পর্যায়ে গাছ রোপণে এগিয়ে আসতে হবে।

গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড : ২০১৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এক দিনে ২০ কোটির বেশি গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল ইথিওপিয়া। যে কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। এর আগে ২০১৬ সালে এক দিনে ৫ কোটি গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিল আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এ ছাড়া স্বেচ্ছাসেবী অনেক সংগঠন বিভিন্ন রেকর্ড গড়েছেন। ২০১৫ সালে ভুটানের একদল স্বেচ্ছাসেবক এক ঘণ্টায় ৪৯ হাজার ৬৭২টি গাছ লাগিয়ে বিশ্বরেকর্ড করেছে। পূর্বে এই রেকর্ড করেছিল ভারত।

পরিকল্পিত গাছ রোপণ ও পরিচর্যা : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখতে ও দেশের এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গাছ রোপণের বিকল্প নেই। তবে তা পরিকল্পিতভাবে রোপণ করতে হবে। তাই সরকারি কিংবা সামাজিক সংগঠন কিংবা ব্যক্তিপর্যায় চলুন গাছ রোপণ করি। দেশের অনেক সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকরা বিশেষ ইভেন্টের মাধ্যমে প্রতি সিজনে বৃক্ষরোপণ করে আসছে। গাছ রোপণ আজ যদি শুরু না করেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। পরিবেশের বিপর্যয় থেকে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। পাশাপাশি ছাদকৃষিতেও নজর দিলে নিজ নিজ ভবন অতিরিক্ত তাপদাহ থেকে রক্ষা পাবে। তবে যত্রতত্র গাছ লাগিয়ে রেকর্ড করলে হবে না। গাছ রোপণ শেষে করতে হবে সঠিক পরিচর্যা। সঠিক পরিচর্যা না পেলে গাছগুলো বৃদ্ধি পাবে না। তাই গাছ রোপণে করে পরিচর্যায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

ইসলামের বৃক্ষরোপণ ও বনায়নে গুরুত্ব : প্রকৃতি আল্লাহর দান হলেও এই প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষা আমাদের দায়িত্ব। পরিবেশের অন্যতম অবধারক হলো উদ্ভিদ ও গাছপালা। আমাদের জীবনধারণ ও জীবন রক্ষার সব উপকরণই পাই গাছগাছালি, বৃক্ষতরু ও লতাগুল্ম থেকে। প্রিয় নবীজি (সা.) নিজ হাতে গাছ রোপণ করেছেন, সাহাবিদের গাছ লাগাতে ও বাগান করতে আগ্রহী করে তুলতেন। ব্যক্তিগত ও সামাজিক বনায়নও করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ, পাখি বা পশু যখন তাদের আহার্য গ্রহণ করে, তখন তা তার (রোপণকারী) পক্ষে একটি সদকা (দান) হিসেবে পরিগণিত হয়।’ - (বোখারি ও মুসলিম)

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করল, আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিনিময়ে তাকে এই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিফল দান করবেন।’ - (মুসনাদে আহমদ) গাছের প্রতিটি পাতা আল্লাহর জিকির করে। সেই জিকিরের সওয়াব রোপণকারীর আমলনামায় লেখা হয়।

তাই আমাদের বেশি করে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করা জরুরি। গাছ লাগাতে হবে, গাছের পরিচর্যা করতে হবে এবং অকারণে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে একটি পরিপক্ব গাছ কাটার আগে তিনটি চারা গাছ লাগাতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close