রূপম চক্রবর্ত্তী

  ২২ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শীতের সৌন্দর্যে গ্রামীণ পিঠাপুলি এবং খেজুরের রস

শীতের দিনে খেজুরের রস এবং খেজুরের গুড়ের পিঠা খেতে কিন্তু আমার অসাধারণ লাগে। তাই কয়েক দিন আগে বরিশাল থেকে কয়েক কেজি খেজুরের গুড় এনেছি শীতের পিঠা খাওয়ার জন্য। আমার ছোটবেলায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রামে খেজুরগাছ দেখা যেত। আমাদের বাড়ির কাছের গাইট্টা পুকুর পাড়ে দুইটা খেজুরগাছ ছিল। আমার বাবা নিজেই গাছ কাটতেন এবং ছোট ছোট দুই কলসি রস পেতেন। শীত পড়তেই গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে চলত খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরির কাজ। গুড়ের সুগন্ধে ভরে উঠত গোটা এলাকা। তবে বর্তমান সময়ে খেজুরগাছ কমে যাওয়ায় অনেকটাই কমেছে প্রকৃত খেজুরের রস ও খেজুরের গুড়। তার বদলে বাজারে জায়গা নিচ্ছে নকল ফ্লেভারের খেজুরের গুড়। বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে খেজুরগাছ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। যে হারে খেজুরগাছ নিধন হচ্ছে, সে তুলনায় রোপণ করা হয় না। খেজুরগাছ কমে যাওয়ার একটি কারণ হলো, অনেকেই বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে খেজুরগাছ বিক্রি করে দেয় এবং তারপর নতুন করে আর কেউ খেজুরগাছ লাগায় না। তা ছাড়া গ্রামীণ সড়কের সংস্কারকাজের কারণেও অনেক স্থানে খেজুরগাছ উজাড় হয়ে গেছে।

অনেকটাই হারিয়ে গেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সুস্বাদু খেজুরের রস-গুড়। খেজুরের ভালো রস জোগাড় করতে না পারলেও পাশের দোকান থেকে নলেন গুড় কিনে সে গুড়ের সঙ্গে পানি মিশিয়ে শীতের পিঠা খেতে খুব একটা খারাপ লাগে না। ইউটিউব খুললেই বিভিন্ন রকম শীতকালীন পিঠার রেসিপি পাওয়া যায়। প্রত্যেক দেশেরই লোকজ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকে। শীতের পিঠা বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ। শীত আর পিঠা একে অন্যের পরিপূরক বলা যায়। শীতের সকালে রোদে বসে নতুন চালের ধোঁয়া ওড়ানো গরমণ্ডগরম পিঠাপুলি খাওয়ার মজাই আলাদা। একসময় শুধু শীতের পিঠার জন্য শহর থেকে গ্রামে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এখন পরিবারের সবাই মিলে সে পিঠা খাওয়ার সেই উৎসব রীতি অনেকটাই ম্লান। নতুন চাল, খেজুরের রসের নতুন গুড়ে টইটম্বুর পিঠা বাঙালির শীত উদযাপনকে রঙিন ও উৎসবমুখর করে তোলে।

বেশ কিছু সুস্বাদু পিঠার সঙ্গে আমাদের প্রজন্ম পরিচিত হলেও পরবর্তী প্রজন্ম চিনতে পারবে না। তাই এই পিঠাশিল্পকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু পরিচিত পিঠার নাম পেয়েছি, যেমন ছিটকা পিঠা, দুধচিতই, নারকেল পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতুই পিঠা, ঝাল পিঠা, ছাঁচ পিঠা, নারকেলের ভাজা পুলি, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জেলাফি, বিবিখানা, চুটকি, চাপড়ি, ক্ষীর কুলি, গোকুল, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল, জামদানি, ঝালপোয়া, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নকশি, চাঁদ পাকান, ছিট, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান, পানতোয়া, মালপোয়া, মালাই, মুঠি, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, তেজপাতা পিঠা, তেলের পিঠা, তেলপোয়া, দুধরাজ, ফুল ঝুরি, ফুল পিঠা, বিবিয়ানা, সেমাই পিঠা প্রভৃতি। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় পিঠা হচ্ছে ভাপা পিঠা এবং চিতুই পিঠা। কালের গভীরে কিছু পিঠা হারিয়ে গেলেও এখনো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। শীতকালে শুধু গ্রামবাংলাতেই নয়, শহর এলাকায়ও এখন পিঠা পাওয়া যায়। কদমপুলি নামের যে পিঠাটা রয়েছে সেটা দেখতে ভালো লেগেছে।

শীতকালীন পিঠার অন্যতম উপাদান খেজুর রসের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও খেজুরগাছের সংখ্যা যে কমে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। আজ থেকে ৩০ অথবা ৪০ বছর আগেও প্রায় প্রতিটি গ্রামে খেজুরগাছ দেখা যেত। খেজুরগাছ রস এবং পুষ্টিকর খাবার হিসেবে খেজুর সরবরাহ করে। খেজুর কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার, প্রোটিন, ভিটামিন বি, ভিটামিন কে, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, ম্যাঙ্গানিজসহ বিভিন্ন পুষ্টির ভাণ্ডার। খেজুর খাওয়ার উপকারিতাও অনেক। পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ফলটিতে রয়েছে নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। খেজুর খাওয়ার উপকারিতা হলো এই ফলটি হজমের স্বাস্থ্যের উন্নতি করে, হার্টের স্বাস্থ্য বজায় রাখে, রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। আয়ুর্বেদে খেজুরের অনেক উপকারিতা রয়েছে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসক দীক্ষা ভাবসার বিশ্বাস করেন যে খেজুর প্রকৃতিতে গরম নয়, তবে এর প্রকৃতি খুব শীতল এবং প্রশান্তিদায়ক।

খেজুরের রস প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ। পুষ্টিবিদদের মতে, খেজুর রসে ১৫-২০ শতাংশ দ্রবীভূত শর্করা থাকে। খেজুরের রস রক্তস্বল্পতা দূর করে। খেজুরের রসে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকে, তাই রস বা গুড় পেশীকে শক্তিশালী করে। ম্যাগনেশিয়ামের ঘাটতির কারণে আমাদের অবসন্ন বা ক্লান্তি ভাব আসে। রসে রয়েছে প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম। এটি পান করলে ক্লান্তিভাব দূর হয় এবং দেহের সজীবতা ফিরে আসে। রসে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। দেহের ক্ষতিকর উপাদান বের করে দেয়। রসে পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় এটি বিপাক ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে অতিরিক্ত চর্বি দেহে কম জমে। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে খেজুর রস সংগ্রহ করার সময় এমনভাবে সংগ্রহ করতে হবে, যাতে বাদুড়ের লালা মিশ্রিত না হয়।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে খেজুরগাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। খেজুরের পাতা ও খেজুরের রস দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। একটি পূর্ণবয়স্ক খেজুরগাছ দিনে দুই থেকে চার লিটার রস দিতে পারে। সপ্তাহে ২-৩ দিন বিরতি দিয়ে এভাবে শীত মৌসুমে প্রায় দুমাস রস পাওয়া যায়। কৃষিবিদদের মতে, সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে ফালগুন পর্যন্ত খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায়। একজন গাছি প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত গাছ কাটতে পারেন, যা থেকে ৩০-৩৫ মণ গুড় তৈরি হয়। খেজুরগাছের পাতা দিয়ে পাটি তৈরি হয়ে থাকে। পাটি তৈরি করতে খেজুর গাছের ‘ডাইগ্যা’ লাগে। মৌসুমে একটি গাছের ২০টি পর্যন্ত ‘ডাইগ্যা’ কাটা যায়। একটি পাটি তৈরি করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। সুতরাং কুটির শিল্পের উপকরণ হিসেবেও খেজুরগাছের গুরুত্ব রয়েছে। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে খেজুরগাছ। তাই প্রতিটি জেলায় যাতে খেজুরের চাষ হয়, তার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close