মো. আনসারুজ্জামান সিয়াম

  ২১ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

সমাজব্যবস্থায় শিশুদের সমস্যা ও সমাধান

একটি স্বাধীন দেশ তথা জাতির কর্ণধার হলো শিশুরা। দেশমাতৃকাকে এগিয়ে নিতে একজন শিশুর ভূমিকা অপরিসীম। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্ভাবনী চিন্তা ও এগিয়ে নিতে শিশুরা বদ্ধ পরিকর। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির তথ্যানুযায়ী, জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ শিশু। জাতিসংঘ ১৯৮৯ সালে শিশু অধিকার কনভেনশন (সিআরসি) ঘোষণা করে। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। শিশু অধিকার কনভেনশনের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আঠারো বছরের কম বয়সি সব মানুষই শিশু।’ তা ছাড়া, শিশুদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু আইন প্রণয়ন করেন। শিশুদের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক ও সুপ্ত বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে চাইলে শিশুদের স্বতঃস্ফূর্ত সব কাজে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। জনবহুল এই ভূখণ্ডে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে শিশুরা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া, পুষ্টিহীনতায় ভোগার ফলে নানা রকম রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান সমাজের শিশুদের নানা রকম সমস্যা এবং এর সমাধান নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. মানসিক রোগ : বর্তমানে শিশুরা নানা রকম মানসিক রোগে আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পরিচালিত সম্প্রতি ঢাকায় একটি জরিপে দেখা যায়, ১৮ শতাংশ শিশু, কিশোর-কিশোরীরা বিষণ্ণতায় আক্রান্ত। সাধারণত অল্প বয়সি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এসব মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- অপজিশনাল ডেফিয়েন ডিজঅর্ডার, ডিসলেক্সিয়া, ক্লেপটোম্যানিয়া, এডিএইচডি, অটিজম, কনডাক্ট ডিজঅর্ডার, শর্টটার্ম মেমোরি লস ইত্যাদি।

লক্ষণ...

১. অস্থিরতা। ২. অতিরিক্ত চঞ্চলতা। ৩. অতিরিক্ত রেগে গিয়ে নিজের প্রতি নিজেই আঘাত করে বা অন্য কাউকে আঘাত করে। ৪. অনেক সময় ডাকলে সাড়া দেয় না বরং আত্মমগ্ন অবস্থায় থাকে। ৫. অন্য কারো উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না।

মানসিক রোগে আক্রান্ত শিশুকে দ্রুত সাইকিয়াট্রিক ডাক্তার কিংবা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট দেখাতে হবে। দ্রুত রোগ নির্ণয় করে যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া, পরিবারের সদস্যদের যথাযথ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে মানসিক রোগীকে সুস্থ করা সম্ভব।

২. অনলাইনে আসক্তি : বর্তমানে শিশুরা খেলার মাঠে না গিয়ে অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া, বর্তমান ঢাকায় খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠের ব্যবস্থা নেই। যার ফলে, বর্তমানে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ভিডিও গেম, মোবাইল, ল্যাপটপ ও বিভিন্ন প্রযুক্তি পণ্যসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা সৃষ্টি হয়েছে। শিশুদের মধ্যে অধিক মাত্রায় ভিডিও গেম ও ফেসবুকের মতো ভার্চুয়াল জগতে প্রবেশের কারণে তা ধীরে ধীরে আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। গভীর রাত পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহারের ফলে ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে না। মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে। মস্তিষ্কের ব্যাপক ক্ষতি করে। তাছাড়া, বিরতিহীনভাবে ব্যবহারের ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। আবার, বিরামহীনভাবে ভিডিও গেম খেলার ফলে মৃগীর কিংবা কনভালশন তথা খিঁচুনির মতো স্নায়বিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত সময় শুয়ে অনলাইনে ভিডিও গেমিং এর ফলে হাঁটু ও কোমরে ব্যথা দেখা যায়। আবার, কায়িক পরিশ্রম না করলে চর্বি জমে যায় ফলে লিভার, কিডনি ও হৃদরোগের মারাত্মক ঝুঁকি বেড়ে যায়?।

অনলাইনে আসক্তি কমাতে শিশুদের ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় অনলাইন যেতে দেওয়া যাবে না। শিশুদের জন্য অভিভাবকদের কিছু সময় বরাদ্দ রাখতে হবে যাতে তারা হতাশায় না ভোগে। বন্ধুত্বসুলভ আচরণের মাধ্যমে তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে হবে।

৩. পুষ্টিহীনতা : বাংলাদেশের শিশুরা বর্তমানে মারাত্মক পুষ্টিহীনতার শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশে ভিটামিন- ‘এ’র অভাবে প্রতি বছর ৩০-৪০ হাজার শিশু একেবারে অন্ধ হয়ে যায়। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রয়োজনীয় অনুপুষ্টিকণা বা মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পাচ্ছেন না। জাতীয় জরিপের তথ্যানুযায়ী, প্রতি পাঁচ শিশুর একটি (২১ শতাংশ) রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। তা ছাড়া, আয়োডিনের অভাবে ঘ্যাগ বা গলাফোলা রোগও দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া শিশুরা ম্যারাসমাস বা হাড্ডিসার, কোয়াশিয়রকর বা গা ফোলা এবং রাতকানা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় পুষ্টির অভাবে শিশুদের মুখের বা ঠোঁটের কোনায় ঘা (অ্যাঙ্গুলার স্টামাটাইটিস) দেখা যায়।

পুষ্টিহীনতা প্রতিরোধে আমাদের করণীয় : ১. পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। ২. জন্মের পর থেকে বাচ্চাকে ৬ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ দিতে হবে। ৩. পুষ্টিহীনতার সঠিক কারণ খুঁজে বের করে চিকিৎসা করাতে হবে। ৪. মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি এক্সটা পুষ্টিযুক্ত খাবার খাওয়াতে হবে। ৫. শিশুকে সময়মতো টিকা প্রয়োগ করতে হবে। ৬. শুধু আমিষযুক্ত খাবার না দিয়ে, শাকসবজি খাওয়াতে হবে।

৪. শিশুশ্রম : শিশুশ্রম একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত পরিবারের অশিক্ষিত লোকের পাল্লায় পড়ে শিশুরা কাজে যোগ দিচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখনো ১৮ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে যুক্ত বলে জানা গেছে। কম মজুরি দিয়ে শিশুদের কাজে লাগিয়ে অনেক মালিক বেশি সময় কাজ করিয়ে নেয়। একদিকে শিশুদের যেমন দৈহিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে নানা রকম দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

শিশুশ্রম প্রতিরোধে আমাদের করণীয় : ১. শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করা। ২. শিশুদের জন্য বিনামূল্যে পাঠদান কার্যক্রম চালু রাখা। ৩. উপবৃত্তি প্রকল্প চালু করা। ৪. বিদ্যালয়ে টিফিন প্রোগ্রাম চালু করা। ৫. শিশুদের বিদ্যালয় মুখীকরণ প্রকল্প হাতে নেওয়া।

৫. অটিজম : শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যাই হলো অটিজম। জন্মের প্রথম তিন বছরের মধ্যে সাধারণত এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। আক্রান্ত শিশুর বিকাশ তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। যেমন- ক. সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা। খ. যোগাযোগ স্থাপনে বাধা। গ. আচরণের ভিন্নতা।

আজ পর্যন্ত এই রোগটি পুরোপুরি নিরাময় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সঠিক টেস্ট, চিকিৎসা, থেরাপি এবং কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে শিশুদের ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ জীবন আচরণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব।

৬. সামাজিকীকরণ : সামাজিকীকরণ শেখার অন্যতম মাধ্যম হলো পরিবার। শিশুকাল থেকে সামাজিকীকরণ শেখার মাধ্যমে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। সামাজিকীকরণের মাধ্যমে মানুষ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়। তাই, সমাজবিজ্ঞানী কিংসলে ডেভিসের বলেছেন, ‘সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি পুরোপুরি সামাজিক মানুষে পরিণত হয়।’ এটি একটি জীবনমুখী ও বহুমুখী প্রক্রিয়া। তাই বলা যায়, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে চাইলে সামাজিকীকরণ রপ্ত করা প্রয়োজন।

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই শিশু-কিশোরদের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে নানা রকমের সমস্যা। উপরোক্ত সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে পরিবারসহ সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আজকের শিশুরা আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে উঠবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস

গণ বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close