ইসমাইল মাহমুদ

  ২২ নভেম্বর, ২০১৯

উন্নয়ন

প্রতিটি গ্রাম হোক ‘হুলহুলিয়া’র মতো

বাংলাদেশে ৬৪ জেলার ৪৯২টি উপজেলার ৪ হাজার ৫৬২টি ইউনিয়নে মোট গ্রামের সংখ্যা ৮৭ হাজার ১৯১টি। এর মধ্যে একটি গ্রাম হলো ‘হুলহুলিয়া’। নাটোর জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার এবং সিংড়া উপজেলা সদর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চৌগ্রাম ইউনিয়নের ‘হুলহুলিয়া’ গ্রাম। ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা, শান্ত এ গ্রাম ১৩টি পাড়া নিয়ে গঠিত। চলনবিলবেষ্টিত গ্রামটির আয়তন প্রায় ২ বর্গকিলোমিটার। একটা সময় ছিল এ গ্রামটিতে বর্ষা মৌসুমে তেমন কোনো ফসল হতো না। ওই সময়ে মানুষরা থাকত পুরো বেকার। ফলে গ্রামের প্রতিটি ঘরে অভাব লেগেই থাকত। ওই সময়কালে গ্রামের মানুষের বিদ্যার দৌড় ছিল একেবারেই নগণ্য। কিন্তু বর্তমান চিত্র পুরোপুরি বিপরীত। গ্রামটিতে একজনও নিরক্ষর নেই। বর্তমানে গ্রামটিতে শিক্ষার হার ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা শতভাগ। ছোট ছায়াঘেরা এ গ্রামটির অধিকাংশ বাসিন্দা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। ‘হুলহুলিয়া’ আজ দেশের একটি আদর্শ গ্রাম। গ্রামটির কাহিনি রূপকথাকে হার মানিয়েছে। এই গ্রামে নেই চুরি, ডাকাতি বা মাদকের ছোবল। পারিবারিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক ঝগড়া-বিবাদ নেই বললেই চলে। গ্রামের বাসিন্দারা একে অপরের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ান। আর আনন্দময় মুহূর্তগুলো পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেয়। এটাই এ গ্রামের মানুষের মূল বৈশিষ্ট্য। শত বছর ধরে এ গ্রামে পুলিশ প্রবেশ করেনি, করার প্রয়োজনই হয়নি। সারা বাংলাদেশে এ গ্রামটি আশ্চর্য এক গ্রাম হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। গ্রামের মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ় বা মজবুত। আর গ্রামের মানুষের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করেছে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’।

‘হুলহুলিয়া’ গ্রামটির পেছনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯১৪-১৫ সালের দিকে প্রবল বন্যার তোড়ে পুরো এলাকা প্লাবিত হয়। চৌগ্রাম ইউনিয়নের ‘হুলহুলিয়া’ গ্রাম বন্যায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গ্রামের মানুষের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পুরো গ্রামে প্রচন্ড অভাব দেখা দেয়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গ্রামের অনেক চাষি ধানবীজের অভাবে জমিতে চাষাবাদ করতে ব্যর্থ হন। যারা জমিতে চাষাবাদ করতে পারেননি তারা মনোকষ্ট ও হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে গ্রামের মানুষের ললাটে চিন্তার ভাঁজ। ওই সময়ে গ্রামের মাতব্বর ছিলেন শিক্ষাবিদ মছির উদ্দিন মৃধা। তিনি বিষয়টি নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ওই আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয় গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা হবে। শিক্ষাবিদ মছির উদ্দিন মৃধার আহ্বানে এরই মধ্যে গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে একজন করে লোক নিয়ে বৃহৎ পরিসরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যাদের ঘরে অতিরিক্ত ধানবীজ আছে তারা বিনা শর্তে গ্রামের অন্য চাষিদের ধানবীজ ধার দেবেন। ফসল কাটার পর যতটুকু ধানবীজ ধার দেওয়া হয়েছে, ততটুকুই ফেরত নেবেন। বৈঠকে উপস্থিত সবাই সানন্দে এ প্রস্তাবে সম্মত হন এবং বৈঠকের সিদ্ধান্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার্যকর হয়। গ্রামের প্রতিটি জমি সোনালি ফসলে ভরে ওঠে। যারা ধানবীজ ধার এনে ফসল ফলিয়েছিলেন, তারা সময়মতো ধানবীজ ফেরত দেন। এ ঘটনাটিতে পাল্টে যায় গ্রামের আর্থসামাজিক অবস্থান। গ্রামের ভ্রাতৃত্ববোধ আরো সুদৃঢ় হয়। এ বন্ধনকে চিরস্থায়ী করতে গ্রামের উন্নয়নে একটি সংগঠন করার জন্য সবাই ঐকমত্যে পৌঁছেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে ১৯৪০ সালের পহেলা জানুয়ারি যাত্রা করে ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’। পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৩। এতে একজন সভাপতি, একজন সহসভাপতি ও ২১ জন নির্বাহী সদস্য থাকেন। পরিষদে রয়েছেন পাঁচজন উপদেষ্টাও। গ্রামবাসীরা দুই বছর পর পর সরাসরি ভোটে পরিষদ নির্বাচিত করে থাকেন। গ্রামের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ১৭ বছর তারা কাজ করার পর ১৯৫৭ সাল থেকে নির্বাচিত পরিষদের মধ্য থেকে ‘বিচারক’ প্যানেল তৈরি করে বিচারব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। সেই থেকে এ পর্যন্ত ‘হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ’-এর মাধ্যমেই গ্রামের ‘শাসনব্যবস্থা’ পরিচালিত হয়ে আসছে। গ্রামবাসীদের মধ্যে বড় ধরনের কোনো বিরোধ নেই। ফলে থানা পুলিশ বা আদালতে কোনো দিন যায়নি এ গ্রামের অধিবাসীরা। ছোটখাটো কোনো বিরোধ হলে এই ‘বিচারক’ প্যানেল আলোচনার মাধ্যমেই তা মীমাংসা করে দেওয়া হয়। বিচারক প্যানেল ও পরিষদের ওপর গ্রামবাসীর আস্থা অটুট। ফলে গ্রামবাসীরা ওই বিচারক প্যানেল বা পরিষদের ওপরই আস্থা রাখেন সব সময়। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই গ্রামটিতে নিজেদের শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে।

গ্রামটিতে ১৮৬৯ সালে হুলহুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। পরে বিদ্যালয়টি সরকারীকরণ হয়। বিদ্যালয়টির বর্তমান নাম হুলহুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। শতবর্ষ কাল ধরে গ্রামটির শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পর আর উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল না। এ নিয়ে গ্রামবাসী চরম সমস্যাসংকুল অবস্থায় ছিল। হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ ও গ্রামের মানুষের সহায়তায় ১৯৬৬ সালে গড়ে তোলা হয় হুলহুলিয়া উচ্চবিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়টির যাত্রাকালে শিক্ষকরা বিনা বেতনে ও অর্ধেক বেতনে শিক্ষাদান করেছেন। ১৯৬৯ সালে গ্রামটির বাসিন্দাদের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় একটি মাদরাসা। বর্তমানে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পরিচালনায় দুটি প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয় চালু রয়েছে।

গ্রামটি চলনবিলবেষ্টিত। ফলে একসময় বর্ষা মৌসুমে গ্রামটির যোগাযোগব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম ছিল নৌকা। তবে হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের উদ্যোগে এবং গ্রামের মানুষের আর্থিক ও শারীরিক প্রচেষ্টায় এখন সারা বছর এই গ্রামে যাতায়াত করা যায় সড়কপথে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হুলহুলিয়া গ্রামে গড়ে উঠেছে মসজিদ, মন্দিরসহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ডাকঘর ও দাতব্য চিকিৎসালয়। একটা সময় এই গ্রামে কোনো কবরস্থান ছিল না। ফলে গ্রামের কোনো মানুষ মারা গেলে বাড়ির পাশের পুকুরপাড় ও কোনো উঁচু স্থানে তাকে কবর দেওয়া হতো। হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের চেষ্টায় প্রায় ৩৫ বিঘা জমির ওপর একটি স্থায়ী কবরস্থান করা হয়েছে। এ কবরস্থানটি দেখাশোনা করার জন্য আছে ছয় সদস্যের একটি কমিটি।

হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের মূল কাজ পুরো গ্রামের উন্নয়ন। তাদের সহায়তার জন্য ১৯৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য হুলহুলিয়া ডায়মন্ড ক্লাব’। এ ক্লাবের উদ্যোগে প্রতি বছর গ্রামে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ১৩ সদস্যের একটি কমিটি এই ক্লাব পরিচালনা করে। এ ছাড়া হুলহুলিয়ায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে আসছে শেকড় ও বটবৃক্ষ নামের দুটি অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। এই দুই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা সবাই চাকরিজীবী। তাদের অনুদানে গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, অসহায় মানুষকে সহায়তা ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়। ২০০০ সাল থেকে গ্রামে যাত্রা করে ‘শেকড়’। এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশনের যুগ্ম পরিচালক ড. মো. মনারুল ইসলাম মনাক্কা। এ সংগঠন কাজ শুরু করার পর গ্রামে বেকারত্বের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। ইতোমধ্যে হুলহুলিয়া গ্রামকে বেকারমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

হুলহুলিয়া গ্রামে বাল্যবিবাহ, যৌতুক, মাদক নেই। গ্রামে অধিবাসীদের সবাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসচেতন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় ওই গ্রামের মেধাবীদের দেখে। গ্রামের দেড় শতাধিক সন্তান প্রকৌশলী এবং শতাধিক সন্তান চিকিৎসকও হয়েছেন। এ ছাড়া দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইনবিদ ও কৃষিবিদসহ দেশের সর্বত্র উচ্চপদে কর্মরত রয়েছেন এ গ্রামের সন্তানরা। এ গ্রামের সন্তানদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিক্ষাবিদ মরহুম মছির উদ্দিন মৃধা, আণবিক শক্তি কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক মরহুম হানিফ উদ্দিন মিঞা, আইন মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মরহুম এ কে তালুকদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম এম এম রহমত উল্লাহ, শিক্ষাবিদ মরহুম মফিজ উদ্দিন, মরহুম ফরিদ উদ্দিন শাহ, বর্তমানে নৌবাহিনীর কমান্ডার জামসেদ আলী, সেনাবাহিনীর কর্নেল মঞ্জুরুল কাদির, পল্লী দারিদ্র্যবিমোচন ফাউন্ডেশন (পিবিডিএফ) এর যুগ্ম পরিচালক ড. মো. মনারুল ইসলাম মনাক্কা, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেন্টাল বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মাহাবুবুর রহমান প্রমুখ।

বাংলাদেশে ৬৪ জেলায় মোট গ্রামের সংখ্যা ৮৭ হাজার ১৯১টি। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই রয়েছেন সমাজসচেতন ব্যক্তি। যাদের হাতের ছোঁয়ায় বদলে যেতে পারে এ দেশের প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি জনপদ। আদর্শ গ্রাম হুলহুলিয়ার মতো দেশের প্রতিটি গ্রাম হোক নির্ঝঞ্ঝাট। হুলহুলিয়া গ্রামে কখনোই পুলিশ প্রবেশের প্রয়োজন পড়েনি! কারণ এ গ্রামে বড় ধরনের কোনো মারামারি-হানাহানি, রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনাই ঘটেনি। গ্রামে নেই বাল্যবিয়ে, যৌতুক, মাদক ব্যবসা। পুলিশ যেসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে, সেসব অপরাধমুক্ত দেশের একটি আলোকিত গ্রাম হলো ‘হুলহুলিয়া’। আসুন সবাই মিলে হুলহুলিয়া গ্রামের পথ অনুসরণ করি। দেশটাকে সত্যিকারের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে এর কোনো বিকল্প নেই।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close