নিতাই চন্দ্র রায়

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

পর্যালোচনা

বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় কৃষি

ফসলের জাত উদ্ভাবনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম; পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়; সবজি উৎপাদনে তৃতীয়; চাল, চা ও মাছ উৎপাদনে চতুর্থ; আম উৎপাদনে সপ্তম এবং আলু উৎপাদনে অষ্টম। এসব অর্জনের পেছনে যার সবচেয়ে বেশি অবদান; যার সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব; তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু তার সাংগঠনিক কাজে বাংলার গ্রামগঞ্জ, শহর-বন্দর ও পল্লীর প্রত্যন্ত প্রান্তর ঘুরে বেড়িয়েছেন। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলেছেন, যেন বাংলার অবহেলিত কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষই তার আত্মার আত্মীয় ও পরম বন্ধু।

কৃষকের কষ্টের কথা তিনি জানতেন। খাদ্য ঘাটতির কথাও তার অজানা ছিল না। ১৯৪৩ সালে বাংলার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। এ কথাও তিনি ভুলতে পারেননি। তিনি বলতেন, এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত না খায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় ।

বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই জানতেন স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হলে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। মেধাবী ছাত্রদের কাছে কৃষি শিক্ষা, গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। তাদের পেশার উপযুক্ত মর্যাদা দিতে হবে। কৃষিবিদরাই পারবেন ফসলের উৎপাদন বাড়িয়ে বাংলার ভোখা-নাঙ্গা মানুষের মুখে তিন বেলা আহার জোগাতে। মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমের উৎপাদন বাড়িয়ে অপুষ্টির অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে। তাই ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকসুর এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষিবিদদের চাকরি প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করার এক ঐতিহাসিক ঘোষণা প্রদান করেন। ওই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ, বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সে কারণেই আমাদের কৃষির প্রতি নজর দিতে হবে। কারণ খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। প্লান্ড ওয়েতে আমাদের কাজ করতে হবে। তা যদি করি আমি আশা করি, ৫ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা লাভ করবে। আপনারা নিশ্চয় রাগ করবেন না, দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাল কিনতে পারি না। চাল পাওয়া যায় না। যদি চাল খেতে হয় আপনাদের চাল পয়দা করে খেতে হবে। শতকরা ৯০ জন কৃষক গ্রামে বাস করেন। গ্রামের দিকে যেতে হবে। আমার ইকোনমি যদি গণমুখী না করতে পারি এবং গ্রামের দিকে যদি না যাওয়া যায়, সমাজতন্ত্র কায়েম হবে না, কৃষিবিপ্লব হবে না।’

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি এবং খাদ্য উৎপাদন হতো প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ টন। ওই পরিমাণ খাদ্য দিয়ে দেশের চাহিদা মেটানো সম্ভব হতো না। বিদেশ থেকে তাই ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন খাদ্য আমদানি করতে হতো। সে সময় আজকের মতো সেচ সুবিধা ছিল না। ছিল না উচ্চফলনশীল বোরো ধানের চাষ। দেশি আউশ আর আমনই ছিল কৃষকের প্রধান ফসল। একরে ধান ফলত ১৫ থেকে ২০ মণ। প্রায় সারা বছরই দেশে খাদ্যাভাব লেগে থাকত।

বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দূরদর্শী ও কৃষক দরদি নেতা ছিলেন। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা ৯০ জনই ছিলেন কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষÑ এ কথা তিনি জানতেন। বঙ্গবন্ধুর সময় দেশের সিংহভাগ লোক গ্রামে বাস করত। জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও বেশি আসত কৃষি থেকে। তাই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৭৩-৭৮) সামাজিক ন্যায়বিচার , দারিদ্র্যবিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য তিনি কিছু যুগোপযোগী, বাস্তত ও জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পদক্ষেপগুলো হলোÑ এক. গ্রামাঞ্চলের ২২ লাখ কৃষি পরিবারের পুনর্বাসন ও যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করা। দুই. ফসলের ফলন বৃদ্ধির জন্য ১৯৭২ সালের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৬ হাজার ১২৫ টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাটবীজ এবং এক হাজার ৩৭ টন গমবীজ কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা হয়। তিন. ১৯৭৩ সালের মধ্যেই হ্রাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, দুই হাজার ৯০০ গভীর নলকূপ ও তিন হাজার অগভীর নলকূপ স্থাপনের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করা হয়। চার. পাকিস্তান আমলে দাখিল করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে বাংলার নির্যাতিত কৃষকদের মুক্তি দেওয়া হয় এবং তাদের সব বকেয়া ঋণ সুদসহ মওকুফ করা হয়। পাঁচ. পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা রহিত করা হয়। ছয়. ১৯৭২ সালে ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সারের ওপর ব্যাপক ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে প্রতি মণ ইউরিয়া, পটাশ ও টিএসপি সারের দাম নির্ধারণ করা হয় যথাক্রমে ২০, ১৫ ও ১০ টাকা। সাত. উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকল্পে ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আট. সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। নয়. গরিব কৃষকদের বাঁচানোর জন্য সুবিধাজনক নিম্ন মূল্যে রেশন সুবিধা প্রদান করা হয় এবং তাদের ছেলেমেয়েদের বিনা খরচে বা সরকারি খরচে লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করা হয়। কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সেগুলো কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তার সময়ে বেশ কিছু কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানে মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন ইত্যাদি। এর ফলে কৃষির আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি এবং নতুন নতুন উচ্চফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের দ্বার উন্মোচিত হয়।

৫ বছরের পরিকল্পনায় ৬৫ হাজার গ্রামের প্রতিটিতে বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠনের ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। ওই সমবায় সমিতিতে জমির মালিকের জমি থাকার ব্যবস্থা ছিল। বেকার কর্মক্ষম প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে সমবায় সমিতির সদস্য করার বিধান ছিল। টেস্ট রিলিফ ও ওয়ার্ক প্রোগ্রামের কাজ পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল সমবায় সমিতির মাধ্যমে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূমি খন্ডের দালিলিক মালিকানা অক্ষুণœ রেখে আইল তুলে একত্রীকরণ করে আধুনিক যান্ত্রিক চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন পাঁচ গুণ বাড়ানোর পরিকল্পনাও ছিল বঙ্গবন্ধুর। স্থায়ীভিত্তিতে জমির মালিক ও শ্রমজীবী মানুষের সমন্বয়ে বহুমুখী ও উৎপাদনমুখী সমবায় সমিতি গঠন করে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়, ঠিক সেই মুহূর্তে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও হানাদার পাক সেনাদের দোসর বিপথগামী কিছু অকৃতজ্ঞ সেনা কর্মকর্তার নির্মম বুলেটের আঘাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি উন্নয়নে যে বিপ্লবের সূচনা করেন, সেই পথ ধরেই তার সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে অদ্যাবধি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সার-সেচে ভর্তুকি প্রদান, নন ইউরিয়া সারের দাম চারবার হ্রাস করা, ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান, আউশ চাষে প্রণোদনা প্রদান, আখ চাষ ও কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি প্রদান, কৃষিতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং ঘাতসহনশীল বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবন ইত্যাদি। এসব কৃষিবান্ধব কর্মকান্ডের ফলে দেশ আজ দানা শস্য ও মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বছরে প্রায় ৪ কোটি টন খাদ্যশস্য, ১ কোটি ৬০ লাখ টন সবজি, ৪৩ লাখ টন মাছ, ৭২ লাখ ৬০ হাজার টন মাংস, ৯৪ লাখ ৬ হাজার টন দুধ এবং ১৫৫২ কোটি ডিম উৎপাদিত হচ্ছে।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে মানুষের গড় আয়ু, মাথাপিছু বার্ষিক আয়, দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্স প্রভৃতি সূচকে বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক প্রতিবেশী দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, লাল সবুজের পতাকা থাকবে, কর্মঠ কৃষক থাকবেন, উর্বর মৃত্তিকা থাকবে, তত দিন শস্যের সবুজ শব্দে উচ্চারিত হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম। এ নাম নক্ষত্রের মতো কৃষি ও কৃষকের প্রতিটি আন্দোলনে, সফলতা ও সংগ্রামে অনুপ্ররণা জোগাবে অনন্তকাল।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি)

নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লি., নাটোর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close