মো. আশরাফ হোসেন

  ৩০ মে, ২০১৮

প্রত্যাশা

টিসিবি : কোম্পানিতে রূপান্তর

গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেলে লোকরা সরকারকে দায়ী বিবেচনা করে। যারা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তাদের দ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে নীতিনির্ধারণীমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় এবং ভোগ্যপণ্য সরবরাহের কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হয়। বস্তুত, সরকার অতীতে ভোগ্যপণ্য মূল্য কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এবং পর্যাপ্ত সরবরাহও করতে পারেনি। এ ব্যাপারে সরকারের ওপর জনসাধারণ হতাশ বলা যায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ সরকারের ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ পেতে ভূমিকা রাখার কার্যকর সংগঠন নেই। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) একটি বিধিবদ্ধ এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি অর্থে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য প্রযোজ্য সরকারি নির্বাহী আদেশ, নিয়ম-কানুনের কারণে এটা প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। বর্তমানে পনেরো কোটি টাকার অতিরিক্ত ক্রয়ের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদের ক্রয় কমিটি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন হয়।

বস্তুত, টিসিবির কর্তৃত্ব বৃদ্ধিমুক্ত বাণিজ্যনীতির বিপক্ষে নয়। আজকের পৃথিবীতে সরকারের অবশ্য কিছু কলাকৌশল ও সংগঠন থাকতে হয়, যা ব্যবহার করে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বেসরকারি ভোগ্যপণ্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে টিসিবি এর সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতিবৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বর্তমানে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতিতে দ্রুত কাজ করার ক্ষেত্রে শক্ত প্রতিবন্ধক। এ সমস্যা কেবল সমাধান সম্ভব হবে টিসিবিকে কোম্পানি আইন ১৯৯৪-এর অধীনে কোম্পানিকে রূপান্তরের মাধ্যমে। টিসিবিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো টিসিবির শেয়ার ক্যাপিটাল ৬০ শতাংশ গ্রহণ করবে এবং পরে ৪০ শতাংশ শেয়ার জনসাধারণের কাছে আইপিও পদ্ধতিতে বিক্রি করতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০ শতাংশ; কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় ১০ শতাংশ হারে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনে অবদান রাখতে পারে।

প্রস্তাবিত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিটির অনুমোদন মূলধন হতে পারে টাকা ১,০০০ কোটি, যা প্রতিটি দশ টাকা অভিহিত মূল্যের ১০০ কোটি শেয়ারে বিভক্ত থাকবে। প্রাথমিকভাবে টাকা ২০০ কোটি পরিশোধিত মূলধন নিয়ে কোম্পানিটি গঠন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলো টাকা ১২০ কোটির শেয়ার ক্রয় করে ব্যবসা শুরু করবে। কোম্পানিটি যৌক্তিক হারে মুনাফা করে পরিচালনা করা হবে। কবছর ব্যবসা করার পর টাকা ৮০ কোটির শেয়ার ১০০ শতাংশ প্রিমিয়াম প্রদান করে জনসাধারণের কাছে আইপিওর মাধ্যমে বিক্রি করা যাবে। এতে কোম্পানির মূলধন দাঁড়াবে টাকা ২৮০ কোটি (টাকা ২০০ কোটি শেয়ার ক্যাপিটাল এবং ৮০ কোটি প্রিমিয়াম)।

আলোচ্য কোম্পানির শেয়ারগুলো দুই গ্রুপে ভাগ করতে হবে। টাকা ১২০ কোটি বা ৬০ শতাংশ শেয়ার সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মালিকানায় থাকবে। অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ শেয়ার অন্য গ্রুপে, বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদির মালিকানায় থাকবে। সরকার ৬০ শতাংশ শেয়ারের জন্য মন্ত্রণালয়গুলো কোম্পানিটির সর্বেসর্বা পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বা বোর্ড অব ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যানসহ ছয়জন পরিচালক মনোনয়ন প্রদান করবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চেয়ারম্যানসহ দুটি পরিচালক মনোনয়ন প্রদান করবে। বোর্ড অব ডিরেক্টরস পেশাদার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগদান করবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক চুক্তিভিত্তিক কোম্পানিতে নিয়োজিত হবেন এবং তার কর্মকালে তিনি বোর্ড অব ডিরেক্টরসের একজন পরিচালক হিসেবে গণ্য হবেন। অন্য গ্রুপের বেসরকারি শেয়ারহোল্ডাররা তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে চারজন পরিচালক নির্বাচিত করবেন। কোম্পানি আইনের বিধান মতে, পরিচালকরা প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ হারে অবসরে যাবেন। শেয়ারহোল্ডাররা তাদের পুনর্নির্বাচিত করতে চাইলে তা পারবেন। সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের করপোরেট গভর্ন্যান্স বিষয়ের নির্দেশনার আলোকে বোর্ড অব ডিরেক্টরসের পরিচালকের সংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বোর্ড অব ডিরেক্টরস স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ করবে এবং শেয়ারহোল্ডারদের পরবর্তী সাধারণ সভায় তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে।

আলোচ্য পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিটি ভোগ্যপণ্য সংগ্রহ ও যৌক্তিক মূল্যে বিক্রির মাধ্যমে সরকারের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার হাতিয়ার হিসেবে কার্যকরভাবে অবদান রাখতে পারবে। ভোগ্যপণ্যের বাজারে সরবরাহ স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। যেহেতু কোম্পানিটির মালিকানা সরকার ও বেসরকারি যৌথ, তাই এ কোম্পানির পরিচালক পর্ষদ কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই দেশের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পালন করে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ভোগ্যপণ্যের বাজারে অবদান রাখার জন্য তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি পূর্বশর্ত। বোর্ড অব ডিরেক্টরস যেহেতু কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ তাই দ্রুত কাজ করার জন্য খুবই সহায়ক। যেহেতু পরিচালক পর্ষদের অধিকাংশ পরিচালক সরকারের মনোনয়নপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাই সরকারের উদ্দেশ্য সাধনে তারা কার্যকর অবদান রাখতে পারবে। কোনো পরিচালক সরকারের উদ্দেশ্যের ব্যত্যয় ঘটালে সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্ট পরিচালকের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারবে।

তাই টিসিবিকে উল্লিখিত পদ্ধতি মতে, পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে সরকার ভোগ্যপণ্যের বাজরে মূল্য স্থিতিশীল ও পর্যাপ্ত সরবরাহের নিশ্চিতকরণের একটা কার্যকর হাতিয়ার পেয়ে যাবে। ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল থাকলে এবং সরবরাহ সন্তোষজনক হলে জনমত কখনোই সরকারের বিপক্ষে যাবে না। আর এই কর্মসূচিই হতে পারে জনসমর্থন রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার।

লেখক : পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist