reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৭ এপ্রিল, ২০২৪

‘আত্মহত্যা : দ্বৈরথে দুঃশাসন-ইতিবাচকতা!’

জীবন সৃষ্টিশীল এক অধ্যায়। আর এই চলমান অধ্যায়কে স্বেচ্ছায় শেষ করে দেন অনেকেই। চাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্বে নির্লিপ্ত হয়ে যায় অনেক সৃষ্টিশীল জীবন। এই স্বেচ্ছামৃত্যুর নাম দেওয়া হয়েছে ‘আত্মহত্যা’। সম্প্রতি শিক্ষিত সমাজে উদ্বেগজনকভাবে হার বেড়েছে আত্মহত্যার। এর কারণ ও সমাধান নিয়ে নিজের অভিমত তুলে ধরেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। লিখেছেন সানজিদা জান্নাত পিংকি

ঘুণেধরা আর্থসামাজিক অবস্থা দায়ী

শিক্ষার্থীদের ভেতর আত্মহত্যার প্রবণতা হুট করে বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ হলো ‘রাজনীতি’। রাজনৈতিকভাবে একটা সমাজ যখন বিকল হয়ে থাকে এবং একই সঙ্গে যেখানে দুঃশাসন বহমান থাকে তাও আবার একটা বৃহৎ সময় ধরে সেখানে ইতিহাস এটাই বলে যে সেই ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী মানসিকভাবে অকেজো হচ্ছে। এমন দুঃশাসনের আবহাওয়া যেখানে চলমান, সেখানে ছেলেমেয়েরা ইতিবাচক কোনো কাজ খুঁজে পান না ফলত নেতিবাচকতা পদে পদে। কেননা সুস্থ চিন্তা করারই অবকাশ নেই। সেখানে এই ভয়াবহ ম্যাসাকার হবেই, যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে ঘুণেধরা আর্থসামাজিক অবস্থা যথেষ্ট দায়ী। একজন শিক্ষার্থী সে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে জ্ঞানচর্চার জন্য, অথচ এসেই জড়িয়ে যাচ্ছেন কী করলে উপার্জন বাড়বে সেই রাস্তায়। শুরু হচ্ছে প্রতিযোগিতায় নামা বিসিএস নাকি চাকরি! একটা সমাজের মূল অংশ নিম্নবিত্ত থেকে নিম্নমধ্যবিত্ত, সেখানে রোজ তাদের এমন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যেখানে মুখ তুলে দাঁড়ানোও যেন বিলাসিতা। এখানে লক্ষণীয় একটি বিষয় হলো, একাত্তর-পরবর্তী সময়ে আধুনিকায়ন বলে কিছু একটা শুরু করার প্রয়াস হলো, সেখানে ইউরোপীয় দর্শন প্রচুর বেড়ে যায়, যেখানে আর্ট-ফিল্ম জনরার যত বিষয়াদি আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে মোটা দাগে নিঃসঙ্গতাকে গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করা হয়েছে, সুইসাইডাল বিষয়গুলোই যেন মহত্তম। একই সঙ্গে আমাদের মর্ডান আর্কিটেকচার সেখানেও এই ইউরোপীয় দর্শনের নিঃসঙ্গতার একটা ছাপ থেকে গেছে। যেটাকে চাইলেই পুরোপুরিভাবে দায়ী করা যেতেই পারে। আত্মহত্যা রোধে ধর্মীয় মূল্যবোধ একটা বড় অবস্থান তৈরি করতে পারে, এতে মানুষ মানবিক থেকে আরো মানবিক হয়ে উঠবেন। তবে শুধু ধর্মীয় মূল্যবোধ দিয়ে কার্যসম্পাদন সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে প্রাচ্যের যে লাইফস্টাইল অর্থাৎ পজিটিভ ফিলোসোফি যেটা জীবনমুখী-জনমুখী। যেখানে মানুষকে বাঁচতে শেখানো হয়, সেটা নিয়ে কাজ করলে আমাদের জীবন উদযাপন করা যায়, জীবনকে ভালোবাসা হয়, ইতিবাচকতার চাদরে চলা যায়।

মীর হাবিব আল মানজুর

শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

বন্ধুবান্ধবই হতে পারে ঈশ্বরদূত

শিক্ষার্থীদের মধ্যে হঠাৎ আত্মহত্যাপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের মধ্যে অন্যতম আধুনিক শিক্ষার অভাব। দেশে প্রচলিত শিক্ষাক্রম যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্মার্ট হয়নি, যুগের পর যুগ চলতে থাকা এই আদিম শিক্ষানীতি ২১ শতকে বড্ড বেমানান। চিত্তবিনোদনহীন একঘেয়েমি অ্যাকাডেমিক শিক্ষার প্রেশার, সঙ্গে ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রের দুশ্চিন্তা, যা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ। পাশাপাশি প্রেমে বিচ্ছেদ, পারিবারিক অশান্তি, আর্থিক অভাব ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাকে ত্বরান্বিত করছে। আত্মহত্যার মুখ্য কারণ মানসিক হতাশা। হতে পারে সেটা সম্পর্কের বিচ্ছেদের, পিতা-মাতার সম্পর্কে ফাটলের দরুর, ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার, কিংবা আর্থিক জটিলতার জন্য। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে যে অপরিহার্য হলো অর্থ। অর্থের অভাবে মৌলিক অধিকার অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নিম্ন মধ্যবিত্তের এই দেশে আর্থসামাজিক অবস্থা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূমিকা রাখে। একজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিজীবনের অনেক কিছুই তার পরিবারকে জানাতে বিব্রত বোধ করে, দিন দিন হতাশায় মুর্ষে পড়লেও জানাতে পারে না। এ সময় তার সব থেকে কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারে একজন সহপাঠী বা বন্ধু। হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত একজন মানুষের জীবনে জাদুকরী টনিক হিসেবে আশার আলো ফোটাতে পারে বন্ধুবান্ধব। হতাশায় আত্মহত্যার পথে আগানো মানুষকে আবারও তার পূর্বের ট্র্যাকে ফেরাতে বন্ধুবান্ধবই হতে পারে ঈশ্বরদূত। আত্মহত্যা কি আদৌও কোনো সমাধান হতে পারে! জীবন একটাই, এ জীবনে দুঃখ ছাড়া সুখের কোনো মূল্য নেই। সাহস নিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে এগিয়ে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করাই আসল সার্থকতা। ধৈর্য ধরতে হবে, পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ জরুরি, আর আধার শেষে আলো আসবেই।

সৌমিক আহমেদ

শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

শত বছরের ধারাকে পরিবর্তন করাটাই নেতিবাচক

এমন একটা প্রজন্মে আমরা বাস করছি, যারা রাতে জেগে থাকি, দিনের বড় অংশটুকু ঘুমিয়ে কাটাই। রাতে হালকা খাবারের বদলে ক্যাফেটেরিয়ার উচ্চ ক্যালরির ‘প্ল্যাটার’ বেশি পছন্দ করি, অথচ সকালে ভালো একটা নাশতাা করার বদলে কিছু না খেয়ে কাটিয়ে দেওয়াতেই অভ্যস্ত। অর্থাৎ মোটামুটি মানুষের জীবনের শত বছরের ধারাটাকেই হুট করে বদলে দিতে শুরু করেছে যে প্রজন্ম, তার কর্মফল যে নেতিবাচক হবে; এটাই কি অনুমিত নয়! বিগত বছরে দেশে পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই স্কুলপড়ুয়া। অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের আত্মহননের পেছনে মোটা দাগে যে কারণগুলো জড়িত সেগুলো হলো- পড়াশোনায় ব্যক্তিগত বা পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতা, প্রেমবিষয়ক জটিলতা, বয়ঃসন্ধিকালীন সময়ে আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা আর ক্ষেত্রবিশেষে পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন। যেসব কারণকে একটা জেনারেশন থোড়াই কেয়ার করেছেন, সেই একই কারণে আজকের জেনারেশন আত্মহত্যা করছেন। মুখ্যত যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে (সমাজ বা পরিবারে) মানিয়ে নিতে না পারার, ফলস্বরূপ সন্তানের সঙ্গে তার পরিবারের দূরত্ব তৈরি হওয়ায়। প্রত্যন্তাঞ্চলে থাকা কিশোরীও জানে, টিকটক ট্রেন্ডে কোরীয় তারকার কোন গানটা টপ চার্টে আছে, আর হলিউডের কোনো তারকার পোশাক হালের ফ্যাশন সামলাচ্ছে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উঠতি বয়সের উচ্চাভিলাষী মনকে সামাল দেওয়া যে এখন অনেক উচ্চশিক্ষিত বাবা-মায়ের জন্যও কষ্টসাধ্য বিষয়। আত্মহত্যা প্রতিরোধের প্রশ্নে বর্তমানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক শিক্ষা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। জুজুর ভয় দেখিয়ে সন্তানকে শেখানোর যুগ পার হয়েছে, এখন বোঝানোর মাধ্যমে বাস্তবতা তুলে ধরার প্রয়াস নেওয়ার সময়। মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। সবার সুচেষ্টা যদি থাকে, তবেই বর্তমানের আলোচিত এই ব্যাধি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

গালিব মাহমুদ সৌম্য

শিক্ষার্থী, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

নজর দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে

আত্মহত্যার জন্য মানসিক বিষণ্ণœতা, একাকিত্ব, বঞ্চনা, হতাশা ও দায়ী। সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মান-অভিমানের কারণে আত্মহত্যা করছে শিক্ষার্থীরা। আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে সহপাঠীদের ভূমিকা কার্যকর। কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পরিবার থেকে বিছিন্ন থাকলেও সহপাঠীদের সান্নিধ্যে থাকে বেশি সময়। তাই তারা বুঝতে পারে কোন বন্ধুর মধ্যে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কী চলছে। সহপাঠীরা চাইলে সঙ্গ, সাহস, বুদ্ধি, পরামর্শ দিয়ে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। পড়ানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। কেউ অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে থাকলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এটা শিক্ষকদের যেমন দায়িত্ব তেমনি পরিবারের সদস্যদেরও দায়িত্ব। নেতিবাচক ভাবনা থেকে দূরে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ বৃদ্ধি করা, মানসিক বিকাশ এবং তাদের সহানুভূতির সঙ্গে শুনতে হবে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার পাশাপাশি আচার-আচরণ মূল্যায়ন করতে হবে।

শাহীন আলম

শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close