আসাফুর রহমান কাজল, খুলনা ব্যুরো

  ১২ জুন, ২০১৯

নিষিদ্ধ উপকরণে আইসক্রিম তৈরি

প্রচণ্ড গরমে ওষ্ঠাগত নগরবাসী। এক সপ্তাহ ধরে খুলনায় পড়ছে রেকর্ড পরিমাণ তাপমাত্রা। আর সেই গরমে তৃপ্তি নিতে নানা বয়সি মানুষ খাচ্ছে আইসক্রিম। এর মধ্যে কোনোটা লেমন, কোনোটা অরেঞ্জ আবার কোনোটা চকবার। কিন্তু কী দিয়ে তৈরি হচ্ছে লোভনীয় এসব আইসক্রিম? বিএসটিআই অনুমোদনহীন এসব আইসক্রিম কতটুকু নিরাপদ, যা খেয়ে মানুষকে চিকিৎসক বা হাসপাতালে যেতে হচ্ছে!

গরমকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় আইসক্রিমের কদর। আর এই সুযোগে এক শ্রেণির মৌসুমি ব্যবসায়ী নিম্নমানের আইসক্রিম তৈরি এবং বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তারা বাসাভাড়া নিয়ে চালিয়ে যান তাদের এ ব্যবসা। যেখানে শুধু সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে আবার কারো তাও নেই। তবে সেখানেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সিটি করপোরেশন কোনো আইসক্রিমের কারখানার লাইসেন্স না দেওয়ায় আইস বার লিখে লাইসেন্স নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

নগরীর অধিকাংশ কারখানা মাত্র ২০ থেকে ২৫ ফুটের একটি রুম। রুমের মধ্যে ভেজা এবং স্যাঁতসেঁতে নোংরা পরিবেশ। যার একপাশে শীতলীকরণ যন্ত্রে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম বা আইসবার, আর অন্যপাশে রয়েছে ঘনচিনি, স্যাকারিন, খাওয়ার অনুপযোগী (কাপড়ের) রং, অ্যারারুট, সুইটিক্স, ফ্লেভার, আইসক্রিমের কাঠি এবং বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির লেবেল প্যাক। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে উৎপাদিত আইসক্রিমে ব্যবহৃত হয় প্রসিদ্ধ কোম্পানির মোড়ক। যার মধ্যে নরসিংদীর কিরণমালা, কিরণমালা কুলফি, নোয়াখালীর ‘ইত্যাদি কোয়ালিটি আইসক্রিম’, ক্যাটবেরি, স্পেশাল চকবার, অরেঞ্জ, লোলি অন্যমত, রয়েছে লাল সবুজ রঙের আইসক্রিম। নগরীর খানজাহান আলী হকার্স মার্কেটে এ ধরনের মোড়ক বিক্রি হচ্ছে দেদার। মোড়কের গায়ে রয়েছে উৎপাদিত পণ্যের উপকরণের নাম। যার কোনো অস্তিত্ব নেই কারখানাগুলোতে। নেই কোনো উৎপাদিত পণ্যের মেয়াদ ও মূল্য।

দেশের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির মোড়কের জালে বিভ্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গত দুই মাসে নগরীতে অনেক আইসক্রিম কারখানায় ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেন। সিলগালা করেছে অনেক প্রতিষ্ঠানকে। তার পরও বন্ধ হয়নি সেসব কারখানা। নগরীর আজাদ লন্ড্রি মোড় এলাকায় ৩টি, গল্লামারী অগ্রণী ব্যাংক কলোনি এলাকায় ১টি, টুটপাড়া ফরিদমোল্লার মোড় এলাকায় ১টি, বাগমারা সোনামণি স্কুলের পাশে ২টি, নতুন রাস্তার মোড় এলাকায় ১টি, দৌলতপুর পাবলা এলাকায় ১টি, লবণচরায় ১টি, ফুলতলায় ২টি আইসক্রিম কারখানার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে এগুলোর নিজস্ব কোনো নাম বা সাইনবোর্ড নেই। সবাই চলে বাজার থেকে কিনে আনা মোড়কের নামে।

নগরীর বাগমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আঁখি আকতার জানান, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আইসক্রিম পছন্দ করে। ঈদের পরের দিন পাশের দোকান থেকে একটা আইসক্রিম কিনে দিয়েছিলাম বাবুকে। বাড়িতে ফিরতে না ফিরতে পেটে সমস্যা হয়। হাসপাতালে যেতে হয়েছে। কী আছে এই আইসক্রিমে, যা খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে? প্রশাসন কি দেখে না? প্রশ্ন করেন তিনি।

খুলনা ডাকবাংলো এলাকার ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান মাসুদ জানান, এ ধরনের আইসক্রিম কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। মোবাইল কোর্টে শুধু জরিমানা করলে হবে না। এ ধরনের কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। তারা ব্যবসা করুক, তবে সরকারের আইন মেনে।

টুটপাড়া ফরিদমোল্লার মোড় এলাকার নিউ ইভা আইসবারের মালিক শেখ খোকন জানান, কয়েক দিন আগে মোবাইল কোর্ট ১২ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলেন। খুলনায় হাতেগোনা দু-একটি আইসক্রিম কারখানার বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে। প্রায় সবাই একই ধরনের রং, উপকরণ এবং ফ্লেভার ব্যবহার করে। তবে এসব দিয়ে আমি আর ব্যবসা করব না। আমি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিচ্ছি।

নোংরা পরিবেশ এবং ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার করে তৈরি আইসক্রিম স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে জানান খুলনার সিভিল সার্জন এ এস এম আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, এসব আইসক্রিমে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে শিশুদের অস্থিমজ্জার ক্ষতি হতে পারে। এ থেকে ব্লাড ক্যানসার, কিডনি ও লিভারের ক্ষতি হতে পারে। এ ছাড়া শিশুদের মানসিক বিকাশে এ ধরনের রাসায়নিকের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে।

বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিশন (বিএসটিআই) খুলনার পরিচালক আবদুল মান্নান জানান, আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি করতে গেলে অবশ্যই বিএসটিআই থেকে অনুমোদন নিতে হবে। তা না হলে, সেটি অবৈধ। অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষ থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর খুলনার সহকারী পরিচালক শিকদার শাহীনুর আলম প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, আমরা নিয়মিত পরিদর্শনমূলক অভিযান অব্যাহত রেখেছি। খুলনার জেলার অধিকাংশ আইসক্রিম ফ্যাক্টরির বিএসটিআই লাইসেন্স নেই, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেই, তারা ক্ষতিকর রং, ফ্লেভার, বেনামি প্যাকেট, লেবেল ব্যবহার করে। তা ছাড়া মূল্য, মেয়াদ এবং উৎপাদনের তারিখ নেই। বিভিন্ন অভিযানে ফ্যাক্টরিগুলোতে জরিমানা করেছি এবং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি। খুলনার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুপ আলী জানান, আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তা ছাড়া সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close