নিজস্ব প্রতিবেদক
পরিবারেও ঠাঁই পাচ্ছেন না সৌদিফেরত নারীকর্মীরা
নির্যাতন সইতে না পেরে সৌদি আরব ও লেবানন থেকে ফিরে আসা নারী গৃহকর্মীরা অনেকেই পরিবারেও ঠাই পাচ্ছে না। আর্থিকভাবে পরিবারে সচ্ছলতা আনতে প্রবাসে গিয়ে একদিকে মান-সম্মান খুইয়েছেন, অন্যদিকে দেশে ফিরে হারিয়েছেন সাজানো সংসার। আবার অনেকে পরিবার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন।
পত্র-পত্রিকায় পাশবিক নির্যাতনের খবর জেনে এসব নারীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা জন্মেছে পরিবারের অনেকের। ফলে তাদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না তারা। উপায়ন্তর না পেয়ে অনেকে গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছেন, মেসে থেকে অমানবিক জীবন যাপন করছেন। এয়ার এরাবিয়ার একটি ফ্লাইটে গত ২০ মে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন ইয়াসমিন (ছদ্মনাম)। হবিগঞ্জ থেকে স্বামীর আসার কথা ছিল। স্বামী আলম মিয়ার সঙ্গে এক বছর পর দেখা হবে, আনন্দে বিভোর ইয়াসমিন। স্বামীর অপেক্ষায় বিমানবন্দর টার্মিনালে রাত কাটান তিনি। কিন্তু স্বামীর দেখা আর মেলেনি। সকালে এক আত্মীয়কে ফোন করে জানতে পারেন স্বামী তাকে নিয়ে আর সংসার করতে চান না। মোবাইল ফোনে এমন কথা শোনার পর হতভঙ্গ হয়ে পড়েন ইয়াসমিন।
ইয়াসমিন বলেন, তখন একবার আত্মহত্যার কথা ভাবি, পরে আবার চিন্তা করি কার জন্য আত্মহত্যা করব। বিয়ের সময় দিনমজুর বাবার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকার যৌতুক নিয়েছে সে। বর্তমানে মোল্লারটেক এলাকায় গার্মেন্টস কর্মীদের রান্না-বান্নার কাজ করেন ইয়াসমিন। তার সঙ্গে সৌদি ফেরত আসা আরেক নারীকর্মী রুখসানা বেগম ওই এলাকার হো ইয়ং বিডি গার্মেন্টে কাজ করেন। চাইনিজ এই কোম্পানিতে ইয়াসমিনেরও চাকরি হওয়ার কথা। যদি চাকরি পান তবে সব ভুলে এখানেই বাকি জীবন কাটাবেন বলে জানান তিনি।
লেবানন থেকে ছয় মাস আগে ফিরে আসেন আকলিমা। তিনিও পরিবারের বাইরে। শনিরআখড়ায় এক স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। গত মে মাসে সৌদি ও লেবাননের কর্মক্ষেত্রে মজুরি থেকে বঞ্চিত যৌন ও শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ১২০ জন ফেরত আসেন।
সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা সবারই অভিজ্ঞতা কমবেশি একই রকম। শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, এমনকি যৌন নির্যাতন চলেছে দিনের পর দিন। বিশাল সব সৌদি পরিবারে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিরতিহীন কাজ করে যেতে হতো। ধন-সম্পদে ভরা বলে যে দেশটির কথা তারা এত দিন শুনে এসেছে, সেখানে তাদের ঠিকমতো খাবারও দেওয়া হতো না।
ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সৌদি ফেরত এই নারীরা বিমান থেকে নেমে এলে কান্নার রোল পড়ে। অনেকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে চারদিকে। বিশ্বাস ভঙ্গ আর নির্যাতনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে অনেকে।
এ বিষয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন পোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান বলেন, প্রবাসী নারীদেরও দেশের নারীদের মতো সম্মান নিশ্চিত না করে সৌদিতে নারী শ্রমিক পাঠানো উচিত নয়।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালে এ সম্পর্কিত চুক্তির পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে দুই লাখ নারী শ্রমিক সৌদিতে গেছেন। এর মধ্যে নির্যাতনের মুখে পাঁচ হাজারের বেশি নারী দেশে ফেরত এসেছেন। এদের বেশির ভাগ নারী সৌদি আরবের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে থেকে দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরে আসেন।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এই চার মাসে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে নারীকর্মী গেছে ৩৯ হাজার ৫৭৫ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবেই গেছে ৩০ হাজার ১০২ জন, যা মোট নারীকর্মীর ৭৬ শতাংশ।
জানুয়ারিতে সৌদি আরবে নারীকর্মী গেছে ৯ হাজার ১৭২ জন, ফেব্রুয়ারিতে সাত হাজার ৪৫২ জন, মার্চে চার হাজার ৯৮৬ জন ও এপ্রিলে আট হাজার ৪৯২ জন এবং চলতি মে মাসের ২২ তারিখ পর্যন্ত গেছে চার হাজারের বেশি।
অন্যদিকে চলতি বছর এপ্রিল পর্যন্ত ওমানে নারীকর্মী গেছে তিন হাজার ৬৮১ জন, জর্দানে দুই হাজার ৮৯৬ জন, কাতারে এক হাজার ২৯২ জন, আরব আমিরাতে ৬৫৫ জন ও লেবাননে ৫৫২ জন। অন্য দেশগুলো থেকে নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগে দেশে ফেরার সংখ্যা খুব কম। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারীকর্মীদের ৯৫ শতাংশই আসছে সৌদি আরব থেকে।
"