আবদুস সালাম

  ৩০ মার্চ, ২০১৯

কাকের সঙ্গে রাইদার বন্ধুত্ব

দেখতে দেখতে রাইদার বয়স চার বছর পেরিয়ে গেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দুরন্তপনাও বেড়েছে যথেষ্ট। সে যতক্ষণ পর্যন্ত জেগে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত খেলাধুলা আর কম্পিউটারে কার্টুন দেখে সময়গুলো পার করে। বইপড়া আর খাওয়া-দাওয়া তার কাছে সবচেয়ে বিরক্তিকর। কোনোভাবেই সে পড়তে চায় না। বই দেখলেই তা ছুড়ে ফেলে। কদিন পরেই তাকে নার্সারিতে ভর্তি করা হবে। তাই তার মা সুযোগ পেলেই বকাঝকা দিয়ে পড়াতে বসায়। তাকে লিখতে দিলে ছবি আঁকে। দুদিনেই ছবি এঁকে খাতা শেষ করে। রাইদা এক দিন মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকছে। এমন সময় তার মা তাকে বকা দেয়। সেসময় পাশের রুমে তার বাবা কম্পিউটারে কাজ করছিল। রাইদা তার বাবাকে কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বলে, ‘আব্বু, আম্মু আমাকে বকা দিয়েছে। বলেছে, আর কখনো ছবি আঁকবি না। আর যদি ছবি আঁকিস তা হলে আচ্ছা করে মার দেব। দুদিনেই খাতা শেষ করিস। কোনো অক্ষর লেখার নাম নেই, শুধু বসে বসে ছবি আঁকা। তুমি আম্মুকে একটু বকা দিয়ে দাও তো।’ রাইদাকে কোলে তুলে আব্বু তার আম্মুকে বলে, ‘এই, তুমি আমার মেয়েকে কেন বকা দিয়েছো? ওর যত ইচ্ছা ছবি আঁকবে। তাতে তোমার কী? খাতা শেষ হয়ে যাবে আবার খাতা কিনে দেব। যদি মামনিকে মার দাও তা হলে তোমার খবর আছে। সাবধান করে দিলাম কিন্তু। আর কখনো বকা দেবে না।’ বাবার আসকারা পেয়ে রাইদা আবার ছবি আঁকতে বসে। এরপর থেকে আম্মু খাতা শেষ হওয়ার কথা বললেই বলে সে তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিয়ে বলে, তাতে কী হয়েছে? খাতা শেষ হলে আব্বু কিনে দেবে। মেয়ের কথা শুনে মা মুখটিপে হাসে। কিছু না বলে মাথায় বুলিয়ে আদর করে লিখতে বলে। মায়ের আদর পেয়ে সে আবার লিখতে বসে। রাইদা যথেষ্ট মেধাবী। অল্প দিনেই সে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পড়তে ও লিখতে পারে। ইংরেজি ছোট হাতের ও বড় হাতের লেটারগুলো লিখতে পারে।

এ তো গেল রাইদার পড়ালেখার কথা। খাওয়া-দাওয়ার বেলায়ও তার একই অবস্থা। খাবার যতই ভালো হোক না কেন, সে কোনোভাবেই খেতে চায় না। ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াতে হয়। প্রতিদিনই তার মাকে একইভাবে পরিশ্রম করতে হয়। রাইদাদের ফ্ল্যাটটি একটা ভবনের তিন তলায়। জানালা খুললেই চোখে পড়ে একটা বড় গাছ। সারা দিন গাছের ডালে কাক পাখিদের আড্ডা বসে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে কেউ খাবারের উচ্ছিষ্ট ফেলে দিলে তা খাওয়ার জন্য কাকগুলো ছুটে আসে। প্রায়ই দেখা যায় কাকগুলো মাছ-মাংসের নাড়িভুঁড়ি, হাড়-চামড়া, ছোট ছোট মৃতপ্রাণি ঠোঁট ডালের ওপর বসে খায়। এসব দৃশ্য দেখতে রাইদার খুব ভালো লাগে। খাবার খাওয়ানোর লক্ষ্যে তার মা হঠাৎ হঠাৎ কাকের কথা বলে। গাছের দিকে তাক করে আঙুল উঁচু করে থাকে। আর বলে, ‘ওই দেখ কাকটা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষুনি সব ভাত খেয়ে নেবে।’ একটু আনমনা হলেই রাইদার মা তার মুখে খাবারের দলা তুলে দেয়। মাঝে মাঝে ঘরের সানসেটে খাবার ফেলে দেয়। কাকগুলো সেগুলো খাওয়ার জন্য ছুটে আসে। তা দেখে রাইদা খুশিতে লাফালাফি করে। খাওয়া শেষ হলে কাকগুলো আবার ফিরে যায়।

এক দিন রাইদা কোনোভাবেই খাবার খেতে চায় না। তখন মা তাকে কাকের একটা গল্প বলে। রাইদা মনোযোগ দিয়ে সেই গল্প শোনে। মা বলে, একটা শহরে অনেকগুলো কাক বাস করত। কাকগুলো শহরের লোকদের ফেলে দেওয়া খাবার, মৃতপ্রাণী, পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, ছোট ব্যাঙ, কেঁচো ও নোংরা-আবর্জনা খেয়ে জীবনযাপন করত। ওই শহরের মেয়র ভাবল, কাক কর্কশস্বরে আওয়াজ করে। ওদের ডাকাডাকিতে ভোরবেলায় ঠিকমতো ঘুম হয় না। ঘুম ভেঙে যায়। ওরা দেখতেও খুব বিশ্রী। আমাদের উচিত এই শহরটাকে কাকমুক্ত করা। কোনোভাবেই কাকদের এই শহরে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। যেভাবেই হোক ওদের তাড়াতেই হবে। এক দিন মেয়র ঘোষণা দিলেন, আজ থেকে কেউ কোনো খাবার বাইরে ফেলবে না। প্রতিটি গাছে বিষ স্প্রে করবে, যাতে করে কাকগুলো খুব সহজে মারা যায়। মেয়রের নির্দেশমতো সবাই কাজ শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যেই শহরের প্রতিটি স্থানে কাকের খাবারের খুব সংকট দেখা দেয়। বেঁচে থাকার জন্য কাকগুলো গাছের ফলমূল খাওয়া শুরু করে। বিষযুক্ত ফল খেয়ে অসংখ্য কাক মারা যায়। এর ফলে কাকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অবশিষ্ট কাক বাঁচার একটা উপায় বের করার জন্য কাকরাজার সঙ্গে দেখা করে। কাকদের সব কথা শুনে কাকরাজা বলে, ‘তোমরা ঠিকই বলেছ। আমরা ময়লা-আবর্জনা, মৃতপ্রাণির নাড়িভুঁড়ি, দেহের অংশ, হাড়-চামড়া খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখি। প্লাস্টিক, ফিতা, রশি, কাঁটা টিনের টুকরো, কাপড়ের টুকরো, উল, তুলা, লোহার তার, পলিথিন, কাঠিকুঠি, সাইকেল ও রিকশার স্পোক, সিগারেটের প্যাকেট, ফেলে দেওয়া কাগজ দিয়ে আমাদের বাসা নির্মাণ করি। এভাবে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে রক্ষা করি। এতে মানুষের অনেক উপকার হয়। অথচ আমাদের বোকা, কুৎসিত ও কর্কশ কণ্ঠী বলে গাল-মন্দ করা হয়। আমাদের দেখলে অনেকে ঢিল ছোঁড়ে। আর এখন মেয়র সাহেব শহরকে কাকমুক্ত করার জন্য মৃত্যুফাঁদ পেতেছে। ইতোমধ্যে আমাদের অনেক ভাই মৃত্যুবরণ করেছে। তাই আমাদের উচিত দ্রুত এই শহর ত্যাগ করা। আমরা আগামীকালই এই শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাব।’ কাকরাজার কণ্ঠে সুর মিলিয়ে সব কাক সমস্বরে বলে ওঠে, হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা আগামীকালই এই শহর ছেড়ে চলে যাব। আর কখনো আসব না। সত্যি সত্যিই পরদিন সকালবেলায় সব কাক একযোগে শহর ছেড়ে চলে গেল। কোথাও কোনো কাক দেখা গেল না। এতে মেয়র সাহেব যেমন খুশি হলো, তেমনি শহরের লোকজনরাও খুশি হলো। শহরের কোথাও কাকের ডাক কোনো যায় না। গাছের ডালে কাকের কোনো নীড় দেখা যায় না।

একসময় শহরের লোকজনরা কাকের কথা ভুলে যায়। তারা আগের মতো যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলতে শুরু করে। প্রাণীর মৃতদেহ যেখানে-সেখানে পড়ে থাকে। সেগুলো থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায়। পরিবেশ নষ্ট হয়। জানালা খুলে কেউ ঠিকমতো শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে না। যত দিন যায় ততই পরিবেশের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সকালবেলায় কেউ ঘুম থেকে উঠতে পারে না। অফিস-আদালতে যেতে তাদের দেরি হয়ে যায়। এভাবে ধীরে ধীরে লোকজনরা অলস হয়ে যায়। তখন শহরের লোকজনরা বুঝতে পারে যে, কাক না থাকার কারণে তাদের এ সমস্যা হয়েছে। তারা কাকের প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করে। এক দিন এই সমস্যাগুলো তুলে ধরে তারা মেয়রের সঙ্গে দেখা করে। মেয়র সাহেব তার ভুল স্বীকার করে। সে সবাইকে অনুরোধ করে বলে, ‘এখন থেকে আমরা কাকের কোনো ক্ষতি করব না। যেভাবেই হোক কাকগুলোকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তারা যেন ভালোভাবে বেঁচে থাকে, আমরা সেই চেষ্টাই করব।’ কাকরাজার কানে যখন এই সুখবরটা পৌঁছে গেল। তারপর সব কাক আবার সেই শহরে ফিরে গেল। আর অল্প দিনের মধ্যে শহরটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর শহরে পরিণত হলো।

কাকের গল্প শোনার পর থেকে কাকদের প্রতি রাইদার মনে মায়া জন্মে। রাইদাকে খেতে দিলে সে কাকের জন্য কিছু না কিছু খাবার সানসেটের ওপর ফেলে দেয়। জানালার পাশে রাইদাকে কিংবা তার মাকে থালা হাতে আসতে দেখলেই কাকগুলো ছুটে আসে। তারা বুঝতে পারে সানসেটে কিছু খাবার ফেলে দেবে। সেসব খাবার মজা করে খাওয়া যাবে। খাওয়া শেষ হলে তারা আবার ওড়ে যায়। কখনো-সখনো দু-একটি কাক ওড়ে এসে হঠাৎ করে জানালার গ্রিলে এসে বসে। রাইদার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য কা কা স্বরে ডাকাডাকি করে। কাকের ডাক শুনে রাইদাও ছুটে আসে। সে বুঝতে পারে কাক খাবার চাচ্ছে। কাককে খাবার দেওয়ার জন্য সে মায়ের কাছে ভাত খাওয়ার আবদার করে। তখন মা দেরি না করে হাতের কাছে যা পায় তা-ই তাকে খেতে দেয়। খাবার দেওয়ার সময় মা তাকে সাবধান করে দেয়, সে যেন কোনো খাবার বাইরে না ফেলে। কিন্তু মা চলে গেলেই কে শোনে কার কথা। সেই খাবার সে কাকের দিকে ছুড়ে দেয়। রাইদার বিশ্বাস, কাকদের ঠিকমতো খাবার না দিলে ওরাও এক দিন শহর ছেড়ে চলে যাবে। কাকরা চলে গেলে তার খুব কষ্ট হবে। খুব মন খারাপ করবে। সে চায় কাকদের সব সময় খাবার খাওয়াতে। ওদিকে কাকগুলো ছুড়ে ফেলা খাবার খাওয়াতে দিনে দিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই কাকের সঙ্গে রাইদার বন্ধুত্ব হয়। এতে বাবা-মাও তার প্রতি রাগ করে না। বরং খুশিই হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close