তৌফিক আল ইমরান

  ২৪ জুলাই, ২০১৯

পর্যালোচনা

ইরান মার্কিন সংকট কোন পথে

ইরান সংকটকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্য তথা উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছে। ওমান উপসাগর থেকে হরমুজ প্রণালি, হরমুজ প্রণালি থেকে পারস্য উপসাগর, পারস্য উপসাগর থেকে জিব্রাল্টার প্রণালি সমগ্র উপসাগরীয় অঞ্চলে বিরাজ করছে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি। জিব্রাল্টার প্রণালিতে আটক আছে ইরানের বাণিজ্য জাহাজ গ্রেস ওয়ান। হরমুজ প্রণালিতে ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের ড্রোনকে ভূপাতিত করায় সংকট ঘনীভূত হয়ে প্রায় যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ও তাত্ত্বিকদের মতে, ইরানের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর যে সংকট চলমান রয়েছে তার মূল কারণ হলো মার্কিন প্রশাসন তথা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০১৮ সালে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যাওয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পূর্বসূরি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রতি আক্রোশের কারণে বহুল আলোচিত এই পরমাণু চুক্তি থেকে মিত্রদের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়।

গত জুনের ১৪ তারিখ ওমান সাগরে হরমুজ প্রণালির কাছে নরওয়ের ‘কোকুকা কারিজিয়াস’ ও জাপানের ‘ফ্রন্ট আলটিয়ার’ নামক তেল ট্যাংকারে আকস্মিক হামলা চালানো হয়। তেল ট্যাংকার দুটিতে হামলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরানকে দায়ী করে এবং এ হামলার পরপরই উপসাগরীয় অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেছেন, এটা স্পষ্ট যে তেলবাহী ট্যাংকারে তেহরান হামলা চালিয়েছে। এ ধরনের হামলা বিশ^শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফুজাইরা উপকূল থেকে ৪০ কিলোমিটার আর ইরানের উপকূল থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে সংঘটিত এই হামলায় ইরানকে দায়ী করলে ইরান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। এর আগেও ১২ মে সংযুক্ত আমিরাতের চারটি তেল ট্যাংকারে হামলা হলে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন সরাসরি ইরানকে দায়ী করেন; যদিও তার কাছে এর কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল না। ইরান তখন এ অভিযোগকে হাস্যকর বলে উল্লেখ করে।

ইরান সংকট ঘনীভূত হয়ে যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়, যখন ইরানের রেভ্যুলিউশনারি গার্ড গুলি করে মার্কিন চালকবিহীন ড্রোনকে ভূপাততি করে। ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় ইসলামী রেভ্যুলিউশনারি গার্ড ‘থার্ড খোরদাদা’ নামক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে ‘গ্লোবাল হক’ মডেলের মার্কিন ড্রোনটি ভূপাতিত করে ইরানের হরমুজগান প্রদেশের কুমোবরক এলাকায়।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই ড্রোনটি আকাশের অনেক ওপর থেকে গোয়েন্দা নজরদারির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল। ইরানের রেভ্যুলিউশনারি গার্ডসের প্রধান বলেছেন, মার্কিন ড্রোন ফেলে দিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে খুব স্পষ্ট একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। সেটি হলো : ইরান যুদ্ধ চায় না, কিন্তু দরকার হলে যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করার অভিযোগ অস্বীকার করে। মার্কিন প্রশাসন বলে, ইরান আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় তাদের ড্রোনকে ভূপাতিত করেছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে টহলরত ড্রোনকে ভূপাতিত করে ইরান চরম ভুল করেছে বলে ডোনাল্ট ট্রাম্প টুইটবার্তার মাধ্যমে ইরানকে হুমকি দেন। কেবল হুমকিই নয়, ২১ জুন ডোনাল্ট ট্রাম্প টুইট করে জানান, এর শাস্তিস্বরূপ ইরানে তিনটি সামরিক স্থাপনায় আক্রমণের পরিকল্পনা হবে। পরে হামলায় ১৫০-এর মতো বেসামরিক মানুষ মারা যেতে পারে বলে তা ১০ মিনিট আগেই বন্ধ করা হয়। মার্কিন প্রশাসন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেও ইরানের ওপর আবারও নেমে আসে অর্থনৈতিক অবরোধের খড়গ। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফ এই অর্থনৈতিক অবরোধকে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদ হিসেবে উল্লেখ করেন।

ইরান সংকট তথা ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ হয় ৪ জুলাই ব্রিটেন ও জিব্রাল্টারের স্থানীয় প্রশাসন জিব্রাল্টার প্রণালিতে ইরানের সুপার ট্যাংকার গ্রেস ওয়ানকে আটক করলে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সিরিয়াতে তেল রফতানির অভিযোগে বিট্রিশ নৌবাহিনী ইরানের এ সুপার ট্যাংকারকে আটক করে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে ইরান বিট্রিশ রাষ্ট্রদূতকে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে এবং ইরানে রেভ্যুলিউশনারি গার্ডের সাবেক প্রধান ও নীতিনির্ধারণী পরিষদের বর্তমান সচিব মোহসেন রেজয়ি বলেন, ইরানের তেলবাহী ট্যাংকার ছেড়ে না দিলে তেহরানের উচিত হবে ব্রিটিশ ট্যাংকার আটক করা। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা খোমেনিসহ ইরানি প্রশাসন ব্রিটেনের এই কর্মকান্ডের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র কলকাঠি নাড়ছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ব্রিটিশ প্রশাসন মার্কিন প্রশাসনকে খুশি করতে মূলত এই ট্যাংকার আটক রেখেছে, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ। জিব্রাল্টারের সর্বোচ্চ আদালত ট্যাংকারটিকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত আটকে রাখা যাবে বলে আদেশ দিয়েছেন।

ইরানের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন ও তার মিত্রদের দ্বন্দ্ব যখন তুঙ্গে; তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে প্রশ্ন তা হলো এই দ্বন্দ্ব কোন পথে এগোবে? ভবিষ্যতে এই দ্বন্দ্ব সামরিক সংঘাতে রূপ নেবে; নাকি ইরান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান করবে। ইরান সংকটের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করতে গেলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। মধ্যপ্রাচ্যে ১০০০ অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ কিংবা বি-৫২ বিমান মোতায়ন এবং হরমুজ প্রণালিতে নতুন করে ইরানি ড্রোনকে ভূপাতিত করে সামরিক উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও সরাসরি মার্কিন প্রশাসন কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না।

কেননা ইরানের ওপর সামরিক আগ্রাসন বা হামলা যাই বলি না কেন, তার পরিণাম ভয়াবহ হবে। এ বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করে ডোনাল্ড ট্রাম্প ড্রোন হামলার জবাব হিসেবে সামরিক হামলা চালানোর ১০ মিনিট আগেই তা বন্ধ করে দেন। ইরানের ওপর যেকোনো সামরিক আগ্রাসন বা আক্রমণ বিশ^ অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। কেননা সেক্ষেত্রে হরমুজ প্রণালি ও পারস্য উপসাগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে ইরান। হরমুজ প্রণালির সবচেয়ে সংকীর্ণ যে অংশ, সেখান থেকে ইরান ও ওমানের দূরত্ব মাত্র ২১ মাইল। পৃথিবীর মোট রফতানিকৃত জ¦ালানি তেলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ রফতানি হয় এ পথ দিয়ে। প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি হয় এ পথ দিয়েই। হরমুজ প্রণালির একপাশে মার্কিন মিত্র রাষ্ট্রগুলো অবস্থিত এবং অন্য পাশে ইরান। সুতরাং বিশ^ বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন মিত্রদের বাণিজ্য তথা তেল রফতানির কথা বিবেচনা করেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সংঘাতে যাবে নাÑ এ কথা সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়।

সংবাদ সংস্থা সিএনএন ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপ না নেওয়ার পেছনে কতগুলো কারণ উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, সবশেষ ২০০৩ সালে ইরাকের বিরুদ্ধে যখন মার্কিন সামরিক আগ্রাসন চালায়; তখন ব্রিটেন, ফ্রান্স অন্য মিত্রদের যেভাবে পাশে পেয়েছিল, ইরানের ক্ষেত্রে সেটি আর হবে না। অন্যদিকে ইরানের পক্ষে আঞ্চলিক নানা শক্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আক্রমণ মোকাবিলা করতে ইরান যেমন অনেক ক্ষেত্রেই সফল; তেমনি লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী এবং ইরাকি শিয়া মিলিশিয়া এমনকি সিরিয়া বাসার আল আসাদ সরকারও ইরানের পক্ষে প্রক্সি শক্তি হিসেবে লড়তে পারে যুুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে।

সিএনএনের বেন ওয়েডম্যান বলছেন যে, সৌদি আরব, ইসরায়েল ও আরব আমিরাতের মতো মিত্রদের পাশে পেলেও তা যথেষ্ট নয় ইরানে সামরিক আগ্রাসনের ক্ষেত্রে। সুতরাং অবস্থা দৃষ্টিতে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের পরিবর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধই প্রধান কৌশল। ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবরোধের দ্বারা ইরানকে ধরাশায়ী করতে চায় মার্কিন প্রশাসন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাবেদ জারিফ দুই দিন আগে এনবিসি এবং বিবিসির সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অর্থনৈতিক অবরোধ এবং যুদ্ধ একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ। তার মতে, অর্থনৈতিক অবরোধের দ্বারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাধারণ ইরানিদের ওপরে বিরূপ প্রভাব ফেলতে চায়। যার কারণে ইরানি জনগণ বর্তমান প্রশাসনের ওপরে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে তাদের পরিবর্তন চাইবে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রচেষ্টাকে জাভেদ জারিফ সন্ত্রাসবাদের ধ্রুপদী রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসন ইরানের শাসনক্ষমতার পরিবর্তন চায় না বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। এমনকি ডোনাল্ট ট্রাম্প শেষ সময়ে এসে সুর নরম করার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তিনি ক্যাবিনেট মিটিংয়ে বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈীি সক্ষমতা অর্জন থেকে নিবৃত্তকরণই তাদের প্রধান লক্ষ্য।

প্রকৃতপক্ষে যদি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা অর্জন থেকে নিবৃত্ত করতে হয়; তা হলে ট্রাম্প প্রশাসনের পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাছড়া মার্কিন মিত্র শক্তিসমূহ ও চুক্তির বাকি পক্ষগুলোও পারমাণবিক চুক্তিতেই ভরসা রাখছে। মোদ্দাকথা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে যে পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল; যা ছিল এই ইরান সংকটের মূল কারণ আর এই চুক্তিতে ফিরে এসেই ইরানের সঙ্গে দেন-দরবারই হবে বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের অন্যতম পথ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close