আজহার মাহমুদ

  ০৫ মে, ২০১৯

অভিজ্ঞতা

একটি রেলভ্রমণ কিছু অজানা রহস্য

বাংলাদেশ রেলওয়ে। যার সঙ্গে জড়িত আছে কয়েক লাখ মানুষ। এর মূল উপাদান হচ্ছে রেলগাড়ি। এই গাড়ির সঙ্গে জড়িত আছে দৈনিক হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত। বলা যায় সবচেয়ে আরামদায়ক যাতায়াত রেলপথেই। এটা প্রায় পৃথিবীর সব দেশের মানুষ পছন্দ করে। সে পছন্দের স্থান থেকে ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর এই রেলওয়ের যাত্রা শুরু। যাত্রা যখন শুরু হয় তখন এই ভূখন্ডে রাজত্ব করছিল ব্রিটিশরা। তাদের হাত ধরেই এসেছে এই রেলওয়ে। এরপর ব্রিটিশ গেল পাকিস্তান হলো। তখন রেলওয়ের নাম হলো ইবিআর (ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে)। এরপর রক্ত দিয়ে পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। তখন থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে হিসেবে পরিচিত। সব মিলিয়ে আজ ১৫৬ বছরে এসে ঠেকেছে রেলওয়ের বয়স। উন্নয়ন কতটুকু তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের বয়স ৪৭ বছর হলেও এর প্রাপ্তি আর উন্নয়ন দুটিই আছে বেশ। দেশের রেলসংযোগ বেড়েছে, বেড়েছে রেলের যাত্রী আরো কত কি। কিন্তু অনিয়ম? সেটা কি বেড়েছে? হ্যাঁ, সেটাও বেড়েছে বেশ। রেলওয়ের অনিয়ম এসব আমরা হরহামেশা শুনি। কিন্তু এসব কতটা সত্য সেটা নিজের দুই চোখে না দেখলে অজানাই থেকে যেত সব। তেমনি একটা অভিজ্ঞতার কথা বলছি আমি। গত ৪ এপ্রিল রাতের ট্রেনভ্রমণ সে দৃশ্য আমাকে দেখিয়েছে।

টিকিট করতে গিয়ে দেখি দালালের অভাব নেই। একজন আমাকে বলে, তার কাছে টিকিট আছে। আরাম করে বসে যেতে পারব। আমি বলছি, কাউন্টার থেকে নেব। লোকটা বলে কাউন্টারে সিট পাবেন না। আমি বলেছি, সমস্যা নেই। দাঁড়িয়ে যাব। আরেকজন বলে, ভাই টিকিট লাগবে না। আমার সঙ্গে আসুন আমি ট্রেনে আপনাকে বসিয়ে দেব আমার একটা লোক আছে ট্রেনে। ৩০০ টাকা দিলেই হবে। যাই হোক আমি এসব পাত্তা না দিয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট করলাম। যেহেতু ৫ এপ্রিল সকালে আমার কাজ, তাই যেভাবেই হোক আমার যেতে হবে। তাই সিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার টিকিট নিলাম। অতঃপর টিকিট নিয়ে যথাসময় ট্রেনে উঠলাম। ট্রেনে উঠে দেখি প্রচুর মানুষ। সিট শেষ বহু আগে। কিন্তু দাঁড়িয়ে যাওয়ার মানুষ যে এতজন সেটা জানতাম না। তবে এতজন হবে জানলে আমিও ট্রেনে যেতাম না। ট্রেনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে সকালের প্রোগ্রামটা যেন মিস না করি এবং ভালোভাবে পৌঁছাতে পারি। বাসেও অনেকবার ঢাকায় যাওয়া হয়েছে, তাই রাস্তায় জ্যামের অভিজ্ঞতাটাও আছে। সবচে বড় কথা ট্রেনে করে কখনো দূরের ভ্রমণ করিনি। তাই ট্রেনে যাওয়া। কিন্তু মানুষ দেখে আমি রীতিমতো হতভম্ব। এত মানুষ লোকাল বাসেও অনেক সময় উঠতে দেখিনি।

মন খারাপ করে যাত্রা শুরু। অল্প কিছুক্ষণ পর আমার পাশের ভদ্রলোক থেকে জানতে পারলাম এদের কারো টিকিট নেই। বেশির ভাগ অবৈধভাবে ট্রেনের কর্মচারীকে অল্প টাকা দিয়ে উঠেছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, তারাই জামাই আদর পাচ্ছেন। আমি যেখানটাই দাঁড়িয়ে ছিলাম তার পাশের বগিটায় দেখি ট্রেনের কর্মচারীরা নাস্তা বিক্রি করছেন। সেখানেও দেখি ১২ থেকে ১৫ জন মানুষ টুলে বসে আরামে যাচ্ছেন। আমিও হাঁটতে হাঁটতে তাদের পাশে গেলাম। তারা আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে এক ভদ্রলোক এসে টিকিট চেক করছেন। তখন দেখছি, যারা দাঁড়িয়ে আছেন এবং টুলে বসে যাচ্ছেন তাদের প্রায় লোকের টিকিট নেই। কিন্তু টিকিট নেই কেন জিজ্ঞেস করতেই তারা অন্য একজন কর্মচারীকে দেখিয়ে দেন এবং যিনি টিকিট চেক করছেন তিনিও আর কথা না বলে চলে গেলেন। তারপর দেখি যিনি টিকিট চেক করছিলেন তিনি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করে চলে যাচ্ছেন। টিকিট ছিল হাতেগোনা আমাদের কয়েকজনের কাছে। আমরা টিকিট দেখিয়েছি। তখন যিনি টিকিট দেখছিলেন তিনি আমাকে বলছেন, এত দূর দাঁড়িয়ে যাবেন? আমাদের কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলুন। একটা টুল এনে দেবে। কিছু টাকা দেবেন আরকি।

মনে মনে তখন ভাবছি, এই হলো আমাদের রেলওয়ে। টাকা থাকলে যে সব কিছু সম্ভব সেটা আবারও প্রমাণিত। এর মধ্যে আমার কাছে এলো একটা ফোন। ফোনে কথা বলার পর একটু হাসি আর অধিক চিন্তা বেড়ে গেল। কারণ ৬ তারিখ আমার চাকরির ইন্টরভিউ। প্রথম ইন্টারভিউতে পাস করেছি বলেই ভাইবাতে সুযোগ পেলাম। তাই একটু হাসি। আর চিন্তা হচ্ছে কাল ঢাকায় কাজ সেরে আবারও রওনা দিতে হবে চট্টগ্রামে। কী এক অসহ্য ব্যাপার।

যাই হোক যেতে যেতে কুমিল্লা চলে এলাম। স্টেশনে থামার পর দেখি অনেক লোক নেমেছেন। অনেকটা ফাঁকা হলো বগি। দুই-একটা সিটও খালি পড়ে রইল। তবে সেখানে বসার সুযোগও আমাদের নেই। কারণ সেখানে অবৈধ যাত্রীরা বসবেন। আমরা তো বৈধভাবে টিকিট করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। তখন নিজের প্রতি নিজেরই ঘৃণা হচ্ছে। আসলে এ কোন সমাজে আমাদের বসবাস। মানুষও যে কীভাবে তাল মিলিয়ে চলছে। হঠাৎ আমার পাশের লোকটাকে দেখলাম একটা টুলে বসে আছেন। আমার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠেন, ১৪০ টাকা দিলাম তারপর টুলটা পেলাম। তিনি আমাকে বলেন তুমিও একটা টুল নাও। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে যাবা? আমি তখন বলছিলাম, অর্ধেকতো চলে এলাম, আর অর্ধেকও না হয় এভাবে চলে যাব। ঠিক এমন সময় ট্রেনের কর্মচারীর পরিচিত একলোক ট্রেনে উঠলেন। ট্রেনের বগিতে লেখা আছে ধূমপান মুক্ত এলাকা। কিন্তু তার হাতে দেখি সিগেরেট। তাকে দেখি টুল এনে দিলেন তার বন্ধু। তারা সবাই একসঙ্গে দেখি সিগারেট ধরিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। পরিবেশটা তখন আর আমার অনুকূলে রইল না। ধোঁয়ায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দেখি প্রতিবাদও করছেন না কেউ। তাই দ্রুত বগিটা ত্যাগ করে অন্য একটিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রতিবাদ করার সাহস থাকলেও সে মুহূর্তে সাহসটা হারিয়ে ফেলেছি। কারণ একা একজন মানুষ কখন কে কি করে বসে। এসব চিন্তা থেকেই চুপ থাকা। তবুও চুপ থাকতে না পারায় লিখতে বসা। এভাবে অবৈধ যাত্রী, ট্রেনের বগির ভেতর সিগারেট খাওয়া, শব্দদূষণ করা এসব মেনে নিতে না পারায় লিখতে বসা। তবে শেষ এখানেই নয়।

কুমিল্লার পরের এক স্টেশনে একটা লোক নেমেছেন। তার সিট খালি হলে আমার পাশের একজন লোক বসে পড়েন। লোকটার সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা বলেছি আমি। তার নাম জাবেদ। তিনিও আমার মতো জরুরি কাজে ঢাকা যাবেন। লোকটা মনে হয় দাঁড়াতে পারছেন না আর। তাই বসে পড়লেন। কিন্তু বেচারি বেশিক্ষণ বসতেও পারলেন না। হঠাৎ একজন লোক ওঠলেন ট্রেনে। তিনি বসে থাকা সবার টিকিট চেক করেন। সবাই টিকিট দেখান। অতঃপর আমার পাশের লোকটির টিকিটে দেখে সিট নেই, দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তখন লোকটা তাকে উঠিয়ে দিয়ে নিজে বসে পড়লেন। বিষয়টা দেখে আমরা সবাই অবাক। আমার পাশের লোকটা অর্থাৎ জাবেদ তাকে বলছেন, আপনার টিকিট কই? তখন বসে থাকা লোকটি আমার পাশের লোকটিকে যেন তাৎক্ষণিক মারবে এমন ভাব করে কথা বলছেন। তিনি বলছেন, এই ট্রেন তার বাড়ির মতো। এখানে তার সব আত্মীয়। আরো কত কী। এই ট্রেনের সবকিছু তার হাতের নাগালে। যাই হোক সবাই বুঝতে পেরেছি লোকটা কেমন। অপরদিকে পাশের বগিতে কয়েকটা ছেলে সিগারেট খাচ্ছে, তাই ওদিকে যেতেও পারছি না। তাদের হাসি-তামাশার আওয়াজ কিন্তু আমাদের কানে আসছে। এভাবে এসব দেখতে দেখতে ট্রেনভ্রমণ শেষ হলো। একটু পর বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে নামলাম। তারপর নির্দিষ্ট কাজ শেষ করলাম। তারপর চট্টগ্রামে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।

রাতেই চট্টগ্রাম পৌঁছাব। কিন্তু গাজীপুরে সেনাবাহিনীর এক অফিসারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক। তার সঙ্গে দেখা না করলে তিনি আবার রাগ করবেন। তাই গাজীপুর যাওয়া। তখন তিনি আমার জন্য চট্টগ্রামের টিকিটের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যাওয়ার সময় এসি সিট নিয়ে আরামে যাব। যদিও ট্রেনে যাওয়ার সাধ আমার একবারেই ছিল না। কিন্তু টিকিট যখন ঠিক করে রেখেছে প্রিয়জন, তখন তো আর ফেলতে পারি না। অন্যদিকে দুই রাত না ঘুমিয়ে থাকা। উফ, কি কষ্ট। যাই হোক সে জন্য আমাকে কমলাপুর রেলস্টশনে যেতে হবে। আমার সঙ্গে ছিলেন আমার একটা সঙ্গী। তাকে নিয়ে জয়দেবপুর রেলস্টশন থেকে কমলাপুরের টিকিট কাটলাম। টিকিট কেটে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর ট্রেন এল। কিন্তু তারপর যা হলো তা দেখে অবাক আমি।

ট্রেনে বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই। ছাদে দেখি প্রচুর মানুষ। আমার সফরসঙ্গীর একজন ছাদে গেলেন। আমি ছাদে উঠার সাহস করতে পারিনি। তাই কোনোরকম ট্রেনের হাতল ধরে ভেতরে ঠেলে দাঁড়িয়েছি। তখন ভাবছি এটাই কি সেই আরামদায়ক ভ্রমণ! যেভাবে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়েছে মানুষ, যেমন দুর্গন্ধ তেমনি নিশ্বাস নেওয়ার কোনো অবস্থা নেই। যেন দম বন্ধ হয়ে আমি মৃত্যুর পথযাত্রী। এভাবে যেতে কত কষ্ট তা নিজে না গেলে বুঝা যাবে না। এভাবে প্রতিটা স্টেশনে উঠানামা হচ্ছে। নামছে বললে ভুল হবে, উঠছেই। সেই বিমানবন্দর স্টেশনে এসেও থামল ট্রেন। কিছু রেলওয়ে পুলিশ বাঁশি বাজিয়ে ট্রেনের ছাদ থেকে সবাইকে নামিয়ে দিচ্ছেন। তখন আমি ভাবছি এরা যদি ভেতরে আসে তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু। এছাড়া আমার এক সঙ্গী ছাদে উঠেছেন। তাই তার খোঁজ করতে অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে নামলাম। এর মধ্যে সবাই যে যার মতো ছাদ থেকে নেমে ভেতরে আসছে। তখন আমার সঙ্গে যে লোকটি ছিলেন তাকে দেখছি না। ট্রেন থেকে নামার পর খুঁজছি। এর মধ্যে তার ফোন। ফোন দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় ভাইয়া? আমি তখন বললাম প্রথম বগির দিকে আসতে। তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। ততক্ষণে ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে। আমরা ট্রেনে উঠতে গিয়ে দেখি বিন্দু পরিমাণ জায়গা নেই। ছাদ থেকে সবাই ভেতরে চলে আসায় একদম টাইটফিট। আমরা শেষ পর্যন্ত ট্রেনে উঠতেই পারলাম না। ট্রেন আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে অথচ আমরা যেতে পারছি না। অথচ টিকিট আমাদের পকেটে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close