সিয়াম বিন আহমাদ

  ১১ নভেম্বর, ২০১৭

ছুটি হলো খেলাঘরের

কার্তিক মাসের এই সময়টা ভারি সুন্দর। হেমন্তকাল। তবুও চারদিকে থৈ থৈ পানি। মুক্ত স্বাধীন বলাকারা উড়ে বেড়ায় পরান ভরে। কখনো কালো মেঘে ডাকা পড়ে এবেলার আকাশ। গাছে গাছে ফুল। নারিকেল ফুলে মুক্তার দানার মতো জমে থাকে বৃষ্টির ফোঁটা। যেন শিশির। দুষ্টু হাওয়ায় দোলে কাশবনের কাশফুল। একটানা ডেকে যায় ব্যাঙ। ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দ কেমন যেন তানপুরার সুর। উঠানের টবে দোলনচাঁপা ফুল। সন্ধ্যায় ঘ্রাণে ভরপুর হয় সারা বাড়ি। সাদা রঙের ফুল। বড় বড় দুটি পাপড়ি। দেখতে প্রজাপতির ডানার মতো। আমি বুড়ির মতো কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াই। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মনটা আজকাল খুব মলিন থাকে। কিসের যেন ভাবনা ওদের।

আমি মেরী। মা-বাবার অতি আদরের সন্তান। সন্ধ্যা নেমে এলে আমাকে ডাকেন মা। পড়তে বসতে হবে এখন। ক’দিন পরেই আমার সমাপনী পরীক্ষা। এজন্যই এত নজর মায়ের। তাড়াতাড়ি এসে পড়ার টেবিলে বসি। খোলা জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। মালতি ফুল ফুটেছে। ফুলের ঘ্রাণ নিতে একটু বারান্দায় যাই। ওদিকে মা চা বানাচ্ছে। মায়ের মুখে চিন্তার ছাপ। সেটা বুঝতে পারি খুব সহজেই। শুধু কারণটা জানা নেই আমার। আর আব্বুও সন্ধ্যা হলে একটা টর্চ লাইট নিয়ে দৌড়ান কালামের দোকানে খবর শুনতে। এতটা খেয়াল করিনি আগে। মাও ক’দিন হলো রাতের খাবার খেয়ে ঘুমান না। অপেক্ষায় থাকেন কখন আব্বু আসবে। আব্বু এসে হতাশ গলায় কী যেন বলেন আম্মুকে। আম্মুর চিন্তা আরো বেড়ে যায়। আমি এসব কিচ্ছু বুঝি না। আম্মু চুলে বেনি করে দেয় না আগের মতো। সারাদিন এমন এলোমেলোই থাকে। এদিকে আম্মুর কোনো খেয়ালই নেই। নানুকে ফোন করে মাঝে মাঝে কাঁদে। ওদিক থেকে নানুর কথা আমি শুনতে পাই না। আগে নানু আম্মুর সাথে কথা বলে আমাকে চাইত। এখন নানুও চায় না। আর আম্মুও আমাকে দেয় না। আম্মুর কাছে জানতে চেয়েছি কতবার, এত্ত চিন্তা কর কেন? আম্মু শুধু বলল, দেশের অবস্থা ভালো না। সারাদেশে বন্যা। আমি অধীর আগ্রহে জানতে চাইলাম বন্যা কী? আম্মু চোখ বড় বড় করে বলল তোর এত্তসব জানতে হবে না। তখনই ফন্দি এঁটেছিলাম। মেঝ বুবুর কাছে গিয়ে শুনব কাল। মেঝ বুবু খুব ভালো। আম্মুর মতো কথায় কথায় এত রাগ করে না। পাশে বসলেই হেসে হেসে কত্ত সব ঘটনা বলে। যদি কিছু জানতে চাই আরো খুশি হয়। সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে সব। চলে আসব বললে, ‘বলে আবার আসিস।’ আসার সময় বাদাম, বুট, এমনকি থাকলে পিঠেও দিয়ে দেয় এতগুলো।

রাত ১১টা। আমি তখনো ঘুমাইনি। ভাবছি, আব্বু এসে কী বলে শুনব আজ। খুব খেয়াল করে শুনব। বুবুকে সকালে বলতে হবে তো। দূর থেকে আব্বুর কণ্ঠ শুনেই ঘুমের ভান ধরলাম। কাঁথা দিয়ে মুখও ঢাকলাম। তারপর দেখি ঠক ঠক আওয়াজ হলো। বুঝলাম আম্মু দরজা খুলছে। নিজেকে আরো লুকালাম। কিছুক্ষণ নীরব সবাই। সাথে আমিও। আব্বু তারপর বলতে লাগলেন, বন্যার অবস্থা খুব ভয়াবহ। ছাব্বিশটি জেলা একেবারে তলিয়ে গেছে। আমি কখনো বন্যা দেখিনি। কেমন এ বন্যা? আম্মুও বলল না সেদিন। আব্বুর কাছে জানতে চাইলে, যদি আবার আম্মুর মতো বকা দেয়। তাই তখনো কিছু বললাম না। চুপ করে শুনেছি সব।

‘তাড়াতাড়ি রাতেই সব গুছিয়ে রাখ। সকাল হতে না হতেই আমরা বেড়িয়ে পড়ব।’ আমার খুব ভয় হচ্ছিল তখন। কোথায় যাব আমরা? কাঁপতে কাঁপতে কাঁথাটা সরিয়েই বললাম এবার। আম্মু এবার রাগ করলেন না। চিন্তিত মুখে খানিক হাসি টেনে বললেন- তোমার নানুর বাড়িতে যাচ্ছি। সকালেই আমরা রওনা হব। আমি তো শুনে মহাখুশি। কতদিন যাই না নানুর বাড়ি। নানুর বাড়ি বহুদূর, পদ্মা নদী পাড়ি দিতে যেতে হয়। কবে গিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই। আম্মু কথা না বলে তাড়াহুড়ো করে সব গুছিয়ে নিচ্ছেন। আমিও গোছাতে আরম্ভ করলাম এবার। বই, খাতা, কাঠ পেন্সিল আগে ব্যাগে ঢোকালাম। বাকি এখন খেলার সামগ্রী। তবে এত্তসব ব্যাগে ঢোকানো যাবে না। তাহসীনের দাদু রাগ করে বলে তাহসীনেরগুলোও রেখে গেছে এখানে। মহাচিন্তায় পড়লাম ওসব নিয়ে। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। সকালে আম্মুকে না বলেই গেলাম তাহসীনদের বাড়িতে। গিয়ে দেখি ঘরগুলো তালাবদ্ধ। কাঁঠাল পাতায় ভরে আছে উঠোন। উই পোকারা বাসা বেঁধেছে রান্নাঘরে। মনে হচ্ছে কতদিন এখানে থাকে না কেউ। ওদিকে আম্মু আমাকে খুঁজছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। আম্মুর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোথায় গিয়েছিলি? আমি চুপ করে রইলাম। আর কিছু বললেন না। আব্বু মস্তবড় একটা গাট্টি মাথায় করে ঘর থেকে বের হলেন। আম্মুর হাতেও দুটো ব্যাগ। আমাকে কিছুই দিল না। মনটা আরো খারাপ হলো। তবুও আম্মুর সাথে হাঁটছি আমি। ফুলের টবটা চোখে পড়লো এবার। সেই দোলনচাঁপা ফুলের টব। খুব কষ্ট হচ্ছে ওদেরকে একা রেখে যেতে। এই দু’দিনে আরো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে চেহারাটা। ঘ্রাণও দেয় না আগের মতো। মনটা খারাপ। আম্মুকে এবার একটু ভয়ে বললাম, আম্মু এটা নিয়ে চলো না। আমি তো পারি না। আম্মু চোখ রাঙালেন। ছোট্ট একটা ধমকও দিয়ে বলেন, ‘তাড়াতাড়ি হাঁট।’ আব্বু তখন অনেক সামনে চলে গেছে। মনটা খারাপ করারও সময় পাচ্ছি না। তাড়াতাড়ি হাঁটতে হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় আমাদের স্কুলের কাছে চলে এলাম। দূর থেকেই স্কুলের হই চই কানে এলো। স্কুলে আজ অনেক মানুষের ভিড়। সবার হাতেই গাট্টি, ব্যাগ, এমনকি খাবারও। উপরে তাকাতেই দেখি তাহসীন। সাথে ওর আব্বু আম্মুও। তাহসীনের মনটা খারাপ। কে জানে কেন? আমাকে দেখেও কোনো কথা বলল না। শুধু তাকিয়ে রইল। আমিই হাত ইশারা করে বললাম, আমরা নানু বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি ততদিন মারিয়া তাবাসসুমের সাথে খেলা কর। আমি কবে ফিরবো জানি না। মা বলেছে, বন্যা গেলেই চলে আসব। তাহসীন এবার হাত ইশারা করে আমাকে

বিদায় জানাল।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist