ড. এম এ সবুর

  ০৬ এপ্রিল, ২০২৪

শিশু-কিশোরের ঈদ-আনন্দ

ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ। এ আনন্দ-খুশির বার্তা নিয়ে প্রতি বছরই ঈদ আসে। আর ঈদের আনন্দ-খুশি উপভোগে সব মুসলমানের অধিকার আছে। তবে শিশু-কিশোরদের ভাগে আনন্দের পরিমাণ একটু বেশিই থাকে। এ দিনে ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা, কিশোর-তরুণসহ সব বয়সের এবং সব পেশার মুসলমান সমবেত হন ঈদের ময়দানে। হাতে হাত, বুকে বুক রেখে পরস্পর কোলাকুলি করেন পরম মমতা নিয়ে। পুরোনো দিনের হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে তারা পরস্পরে আবদ্ধ হন ভালোবাসার বন্ধনে। এতে মুসলিমসমাজের ঐক্য, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের আসল চিত্র ফুটে ওঠে।

ঈদ নিয়ে শিশু-কিশোরদের অনেক পরিকল্পনা থাকে। ঈদের পোশাক কেমন হবে? কোন জামা পরে ঈদের নামাজ পড়বে? কোন জামা পরে ঘুরতে যাবে? জুতা কী ডিজাইনের হবে? কোথায় ঘুরতে যাবে? কাকে কী উপহার দেবে? কোন ফ্রেন্ডকে কী ধরনের ঈদকার্ড দেবে? কার কাছ থেকে কত সেলামি নেবে ইত্যাদি ভাবনা তাদের মনে আগে থেকেই বাসা বাঁধে। আর সবার আগে ঈদের চাঁদ দেখা, ঈদের দিনে সবার আগে ঘুম থেকে জাগা, সবার আগে ঈদের মাঠে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাদের মধ্যে প্রীতিপূর্ণ প্রতিযোগিতা চলে। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, দলবেঁধে ঘোরাফেরা-আড্ডায় তারা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। এমনিভাবে ঈদের আনন্দ-উৎসবকে তারা দারুণভাবে উপভোগ করে।

ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে কৌতূহল বেশি থাকে। কে আগে চাঁদ দেখেছে বা দেখবে এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। এ জন্য চাঁদ দেখতে অনেকে বাসার ছাদে, খোলা মাঠে, উঁচু জায়গায় অবস্থান নিয়ে থাকে। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ‘আল্লাহু আকবার’, ‘ঈদ মোবারক’, ‘আস্সালামু আলাইকুম’ ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। এমনকি ঈদকে স্বাগত জানিয়ে অনেকে আনন্দ মিছিলও করে। অবশ্য বর্তমানে আকাশে চাঁদ দেখার চেয়ে রেডিও-টেলিভিশনের খবরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। এ জন্য নিজ চোখে চাঁদ দেখার কৌতূহল-উল্লাস কমেছে। তবে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রবণতা বেড়েছে। আগের দিনে বড়দের মতো কিশোর-তরুণরাও বিভিন্ন ডিজাইনের কার্ড দিয়ে বন্ধু-আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করত। তাদের অনেকেই ঈদকার্ডে নিজ হাতে আলপনা আঁকত, কেউ কেউ কবিতাণ্ডছন্দ লিখে আমন্ত্রণ জানাত। এখন অধিকাংশ কিশোর-তরুণ আধুনিক প্রযুক্তিতে মোবাইলের খুদে বার্তা, ফেসবুক, টুইটার, ভাইভারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। চাঁদরাতে কিশোর-কিশোরীদের ব্যস্ততা বেশি থাকে। সবার আগে ঘুম থেকে জাগা, বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজন থেকে সেলামি নেওয়া, ঈদগাহে নামাজ পড়া, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মজা করা, ঈদের পোশাক পরা, এ রকম হাজারো পরিকল্পনা তাদের মাথায় কিলবিল করে। অধিকন্তু বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক-পরিকল্পনা, প্রসাধনীর ব্যবহার কিশোরীদের চাঁদরাতের ব্যস্ততাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ঈদের দিনে শিশু-কিশোররা সাধারণত বন্ধু-আত্মীয়-প্রতিবেশীদের বাসায় বেড়াতে যায়। এ সময় তারা অনেক সেলামি-উপহার পায়। এতে তাদের উল্লাস-খুশির মাত্রা বেড়ে যায়। তবে কিশোর-তরুণরা শুধু আনন্দ-উল্লাসেই ব্যস্ত থাকে না, বরং তারা ঈদগাহে নামাজ পড়তে যায়। এ সময় তারা মহান আল্লাহর দরবারে অবনত মস্তকে তার দয়া-সাহায্য চায়। অতীতের মারামারি-ঝগড়াঝাঁটি, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে তারা পরস্পরে পরম বন্ধুতে পরিণত হয়। ছোট-বড় সবার সথেঙ্গ কোলাকুলিতে পরস্পরের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা বেড়ে যায়। এ ছাড়া ঈদের ময়দানে শিশু-কিশোররা বড়দের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পায় এবং কিশোর মনে সমাজ-সম্প্রীতিবোধ জন্মায়।

নতুন পোশাকপরিচ্ছদ শিশু-কিশোরদের আধুনিক ঈদ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ হয়েছে। তাই ধনী-গরিব সব অভিভাবকই ঈদে শিশুদের নতুন পোশাক দিতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন। তবু অনেকেই নিজের পছন্দ মতো পোশাকের বায়না ধরে। তবে নতুন পোশাক ছাড়াও দরিদ্র-অসহায় শিশু-কিশোরদের ঈদ কাটে। অবশ্য কেউ কেউ নিজেদের একাধিক নতুন পোশাক থেকে গরিব শিশুদের দান করে। এতে সবারই ঈদের আনন্দ-খুশির মাত্রা অনেক গুণ বাড়ে।

আমাদের দেশে ঈদে বেশ কিছুদিন ছুটি পাওয়া যায়। এ সময় দূরের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এবং গল্প-খেলাধুলা করার সুযোগ হয়। এতে শিশু-কিশোররা অনেক আনন্দ ও মজা পায়। ঈদ উৎসবে বড়দের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য বিনোদনমূলক খেলা-প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তবে অনেকে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার পরিবর্তে মোবাইলে-কম্পিউটারে গেম খেলে, ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং রেডিও-টেলিভিশনের বিভিন্ন বিনোদনমূলক কর্মসূচি দেখেশুনে ঈদের দিন কাটায়! এমনকি শহরাঞ্চলের অনেক ঈদ উৎসবে পশ্চিমা ধাঁচের জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে ঈদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও আনন্দ লোপ পায়। অথচ ইসলাম নির্দেশিত ঈদ উৎসব নির্মল ও আনন্দঘন হয়। অধিকন্তু ঈদের দিনে শিশুদের গান-বাজনা (দফ্ বাদ্য) বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর অনুমোদন পাওয়া যায়। আগের দিনে আমাদের দেশে ঈদের উৎসবে বড়দের জন্য হা-ডু-ডু, ফুটবল, কুস্তি খেলা, সাঁতার কাটা, নৌকাবাইচ ইত্যাদি খেলার আয়োজন করা হতো। আর শিশুরা গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ফুটবল, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যদি খেলায় মেতে উঠত। এ ছাড়া তারা মা-খালা, দাদি-নানিদের সঙ্গে হাসি-তামাশা, গল্প করে বেশ মজা করত। এভাবে তাদের ঈদ আনন্দে-উল্লাসে ভরপুর ছিল। অবশ্য এখনো অনেক গ্রামে ঈদ উপলক্ষে শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলা-প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে। আর শহুরে শিশু-কিশোররা বিভিন্ন পার্কে-বিনোদন কেন্দ্রে অর্থের বিনিময়ে আনন্দ-খেলা করতে পারে। এতে ধনী পরিবারের শিশুরা অংশ নেওয়ার সুযোগ পেলেও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বঞ্চিত থাকে।

আমাদের দেশের অনেক শিশু-কিশোরের বাবা-মা দরিদ্র-অভাবী। তাদের অনেকেই বুঝতে পারে না ঈদের আনন্দ কী! ঈদে নতুন পোশাক তো দূরের কথা, পেট পুরে খেতে পারলেই তারা খুশি। তাই এ দিনে অনেক শিশু-কিশোর একটু ভালো খাবারের আশায় বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে যায়! ক্ষুধার জ্বালায় অনেক শিশু-কিশোর ঈদের দিনেও কাগজ-বোতল কুড়ায়! ঘরবাড়ি না থাকায় ঈদের দিনেও অনেক শিশু-কিশোরকে প্ল্যাটফরমে-ফুটপাতে ঘুমাতে দেখা যায়! অথচ অন্যদের মতো তাদেরও ঈদে আনন্দ-উল্লাস করতে ইচ্ছে হয়। তাই অভাবী-অসহায় সবাইকে নিয়েই ঈদের আনন্দ-উৎসব করতে হয়। ঈদের আনন্দ-উল্লাস শুধু একার জন্য নয়। ঈদে বন্ধু, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনকে সাধ্যমতো উপহার দিতে হয়। কারো মনে দুঃখ-কষ্ট থাকলে তা দূর করে তাকে খুশি করতে হয়। কেউ মনে দুঃখ দিলে ঈদের দিনে তা ভুলে যেতে হয়। কাউকে কখনো দুঃখ-কষ্ট না দেওয়ার অঙ্গীকার করতে হয়। কারো সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলতে হয়। গরিব বলে কাউকে অবহেলা-অবজ্ঞা নয়। বরং গরিব-দুঃখীদের ঈদের আনন্দে অংশীদার করতে হয়। তাদের প্রয়োজনীয় পোশাক-খাবার উপহার দিতে হয়। যাতে তারা খুশি হয় এবং ঈদের আনন্দ পায়। এ ক্ষেত্রে মহানবী (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হয়। তবেই ঈদের আনন্দ-উৎসব সুন্দর ও সার্থক হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close