শরীফ সাথী

  ১১ জুলাই, ২০২০

শীর্ষ ও পুটে দাদু

গত কয়েক দিন বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে ডোবা নালা ভর্তি। সারাক্ষণ ব্যাঙের দলের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাকে চারিপাশ সরগরম। এদিক-ওদিক উঁই পোকাদের অনবরত উড়াউড়ি জীবন বিপন্ন। ক্ষুধার্ত পাখিগুলো বাসার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে করুণ কিচির-মিচির ছন্দ সমাহারে ব্যস্ত। পশু ও জনমানুষের স্থবির জীবন। প্রকৃতির এমন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া অবস্থায় ও মাঠে যেতে হয় অনেক কৃষকের গরু-ছাগলের খাবার সংগ্রহে। তেমনি পুটে দাদুর যাওয়া। টোকা বা মাথাল মাথায় দিয়ে হেঁসো কাস্তে হাতে নিয়ে গেরামের মেঠো পথ ধরে সবুজ বনের পাটাচোরা তীরধরা দ্বীপের মাঠে যাচ্ছে। বজ্রবাতির আলো চমকানোই ধপ্ গুড়–ম গুড়–ম করে শব্দ। মেঠো পথের পিচ্ছিল কাদায় লুটোপুটো পুটে দাদুর। পা ভেঙে বেহাল দশা। কাদামাটি অবস্থায় মাঠের লোকজন ধরাধরি করে বাড়ি আনল। বাদল দিনে পরিবারের লোকজনের ব্যস্ততার শেষ যেন। ডাক্তার দেখানো পায়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে পুরো রেস্টে থাকার পরামর্শ মাস তিনেকের। ভোগান্তির এই জীবনে বিকালে ঘরের বারান্দায় বসে বৃষ্টি রিমঝিম কলকলা শব্দ মায়াময় ছন্দ তুলছে দু”কর্ণে পুটে দাদুর। এমন সময় নাতি শীর্ষ এলো দাদুর কাছে। পুটে দাদু মুচকি হেসে বললেন, আগেকার সেদিন আর এখনকার এদিন অনেক পার্থক্যরে নাতি। নাতি শীর্ষ বলল, কি রকম দাদু ভাই?

এই যেমন তুমি টুকটুকে টকালো মোলাটের প্যাকেটের চিপস্ এনে খাচ্ছ আমার পাশে বসে। আর আগেকার দিন ওই দেখো ওই খড়ের ঘরের চালের বাতায় পর পর অনেকগুলো ছিকি টাঙানো থাকত। নাতি বলল, ছিকি কি দাদু ভাই? দাদু বললেন, সবই বলছি দুষ্টু নাতি। তুমি খাও আর মনঃযোগ দিয়ে শোনো। ছিকি হলো পাটের দড়ি পাকিয়ে বোনানো বিভিন্ন ডিজাইনের নকশা করা ঝুল। ঘরের চালের আড়ার সঙ্গে বেঁধে ঝুলে ঝুলে রাখা এবং ওর ভেতরে মেটে হাঁড়ি, কাঠা, কলসি, গামলা ইত্যাদি সাজিয়ে রাখা হতো। হাঁড়ির ভেতর মুড়ি মুড়কি থাকত। কোনোটায় আবার বানানো চালের পিঠাবোঝাই থাকত। গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ির রান্না ঘরে ছিকি শোভা পেত। তরিতরকারির মাটির মালসা, এমনকি ভাতের হাঁড়িও রাখা হতো। রান্নাঘর বা হেসেল ঘরের কোণায় কোণায় থাকত মেটে কোলা। ঠিক এখনকার ব্যারেল ঢপের মতো দেখতে। চাষাবাদের জন্য ধান-গম বীজ যতœ সহকারে রাখা হতো কোলা বোঝাই করে। ধান ভানা চাল কোটানোর জন্য হেসেলের একপাশে ঢেঁকি থাকত প্রায় বাড়িতে। এসব এখন আর দেখা যায় না। দেখা যায় বিভিন্ন প্লাস্টিকের এবং স্টিলের র‌্যাক আলমারি। বর্ষার দিনে আজ যেমন তুমি চিপস্ চানাচুর খাচ্ছ। আমরা তখন মুড়ি মুড়কি চিড়া ছোলা ভাজা চিবাতাম আর আমার দাদুদের কাছে বসে গল্প শুনতাম। আহা কি যুগ এল! আগের দিনের ছিকি থাকা খই মুড়ি গুড়, মিষ্টি মধুর খেয়ে কত মজা পেতাম। গম চাল ডাল এক সঙ্গে ভেজে ঢেঁকিতে বা যাঁতায় পিশে কি মজাদার ছাতু হতো। খেজুর বা আখের গুড় মিশিয়ে আয়েশে খাওয়ার নির্ভেজাল নিঃশ্বাস সত্যিই বিশ্বাস স্থাপনে মনে করার মতো। সে সময়ে পাড়া গাঁয়ে ছাতু খাওয়ার পাল্লা হতো। ভুরো যব চালের যাও, আয়েশে খাও। আহ্ গুড় দিয়ে বানানো মজাদার ক্ষির স্মৃতির মেমরি সাজানো। মাঠের পর মাঠে বোনা ধানের চারায় গরু দিয়ে বিদে ঠেলার দৃশ্য সত্যি অপূর্ব। আমন আউশ চালের পান্তা ভাত। ঝাল পেঁয়াজ ভাত ছানা। গরম ভাতে দেশি খেশারি ছোলা মশুর মুগ কলাইয়ের ডাল আর গাঁয়ের পাশের নদীর ছোট ছোট মাছ সত্যিই নাতি ভাই মাছে ভাতে খাঁটি বাঙালি ছিলাম। বুনো ওল কচুশাক পুষ্টিকর কত সবজি? গাছের পাকা পাকা কত রকম দেশিও ফল। কাঁচা হোক আর পাকা হোক পেঁপে, কলা, আম, জাম, লিচু ও পেয়ারা। এখন আর গ্রামের মানুষ জাতীয় ফল কাঁঠালই খাচ্ছে না। ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে কাঁঠালগাছ বিলীন হচ্ছে। এখন দেশে আবাদ হচ্ছে নতুন নতুন উচ্চ ফলনশীল ধান। বারো মাসই ধান চাষ হচ্ছে। ভাতের অভাব নেই। আর তখন ভাত বেগোরে উপোস, কত কিছু খেতে হয়েছে। থাকতে হয়েছে ছাতু খেয়ে। গোয়ালভর্তি গরু থাকত। রাখাল কৃষাণ থাকতেন। এখন হয়েছে ছাগল-গরুর ফার্ম। তখন গরুর দুধ, দই কবজি ডুবিয়ে খাওয়া কত কথা মনে পড়েরে নাতি। এখন দেখছি বর্ষা মৌসুম জুড়ে বিভিন্ন রকমের ছাতার সমাহার। আর আগে মাথায় টোকা, গোলপাতার ছাতা বানিয়ে ব্যবহৃত হতো। তখন মানুষে মানুষে কত মহাব্বত ছিল। সন্ধ্যার এমন ক্ষণে শীর্ষের আম্মু বলল, শীর্ষ ঘরে এসে পড়তে বসো? শীর্ষ বলল, আম্মু আমি ছাতু খাব। শীর্ষের এমন কথায় দাদু এবং আম্মু দুজনেই হেসে উঠলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close