কাইয়ুম আহমেদ

  ২৭ জানুয়ারি, ২০২৪

ঝুঁকিতে তারুণ্য

বাসের হাতলে স্বপ্ন ঝোলে

মাহাবুর, উনিশ ছুঁইছুঁই। এ সময় তার কলেজে থাকার কথা; কিন্তু এখন তিনি শ্রমে-ঘামে নিঃশেষ করছেন তার তারুণ্য। পরিবারের অভাব-অনটনে তার স্বপ্নগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে বাসের হাতলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। ঢাকার ডেমরা-হেমায়েতপুর পথে চলাচলকারী রাজধানী পরিবহনের বাসচালকের সহকারী তিনি। ভোর ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত তার সময় কাটে যাত্রী ওঠানো-নামানো আর ভাড়া তোলায়।

শুধু মাহাবুরই নন, রাজধানীর বিভিন্ন পথে চলাচলকারী বাসচালকের বেশির ভাগ সহকারীই কিশোর-তরুণ। এ কাজ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই ওদের কাছে চ্যালেঞ্জের। আবার অনেকের কাছে এতেই সুখ।

বনশ্রী থেকে আমুলিয়ায় যেতে বাসের মধ্যেই কথা হয় মাহাবুরের সঙ্গে। জানালেন, দেড় বছর ধরে চালকের সহকারীর কাজ করছেন তিনি।

পড়াশোনা কতদূর, জানতে চাইলে মাহাবুর বলেন, “ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ছি। আশা ছিল পড়ালেখা করে ‘বড় মানুষ’ হব, অনেক বড় চাকরি করব, অভাব দূর হবে। কিন্তু সবার জন্য মনে হয় আশা-স্বপ্ন- এগুলো দেখতে নেই। এগুলো হতাশা বাড়ায়, কষ্ট দেয়, বড় কষ্ট”... বলতে বলতে ওর চোখ জলে ভিজে আসছিল। বাসও প্রায় গন্তব্যের কাছাকাছি থাকায় বেশি কথা আর বাড়ল না। পরে দেখা হবে বলে নেমে যেতে হলো। সেদিন ছিল বছরের প্রথম দিন, ১ জানুয়ারি। সে সময় নামটাও ভালো করে জানা হয়নি।

এরপর আবার দেখা হলো ঠিক ১১ দিন পর, শুক্রবার (১২ জানুয়ারি)। আর ছবি তুলতে তার দেখা মিলল আরো ১০ দিন পর, ২২ জানুয়ারি।

পুরো নাম মো. মাহাবুর ইসলাম। বাড়ি লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলার তালুক বানীনগর গ্রামে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। বাবা মো. মোজাফ্ফর মিয়া শ্রমিক। মাহাবুর থাকেন ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে, জাদুুরচরে।

আগে কী করতেন জানতে চাইলে মাহাবুর বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতাম। বেতন কম ছিল, মাত্র ৮ হাজার টাকায় নিজেই চলতে পারতাম না। বছর দুয়েক আগে এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে বাসচালকের সহকারীর কাজ শুরু করি।’

দিনে কত আয় হয়, এমন প্রশ্নে মাহাবুর বলেন, ‘এক ট্রিপে ২৫০ টাকা করে চারবার ট্রিপ দিলে ১ হাজার টাকার মতো আসে।’

এখানে কেমন লাগে, জবাবে বললেন, ‘কষ্টও আছে, দুঃখও আছে। আছে ঝুঁকিও। ইচ্ছেমতো না নামালে কিংবা ভাড়া নিয়ে কথা বললে অনেক যাত্রী গালিগালাজ করেন। যাত্রী ওঠানো-নামানো শেষ হলেই চালক বাস ছেড়ে দেন, তখন দৌড়ে গিয়ে ঝুঁকি নিয়েই বাসে উঠতে হয়, ভয় হয়- যদি পেছন থেকে অন্য গাড়ি এসে পিষে মারে! আবার নেই নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, বিশ্রামের সুযোগ। সব সময় ঝুঁঁকি নিয়ে কাজ করলেও পাই না চিকিৎসা খরচ। কখনো দুপুরের খাবার খাওয়ারও সময় থাকে না। ক্ষুধা লাগলেও কিছু করার নেই। কাজ করতেই হবে।’

তার কথার সূত্র ধরে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেইফটি হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (ওশি) ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষা প্রতিবেদন ঘেঁটে জানা গেল, গত বছর পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি ৬৩৭ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। আর আহত হয়েছেন ১২৭ জন। আগের বছর (২০২২ সাল) নিহত ১০৫ ও আহত ২৯ জন ছিল। অর্থাৎ এই খাতে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল।

মাহাবুর বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় এখন সকালে আসি, রাতে বাড়ি যাই। পরের দিন আবার রাস্তায় নামি। জ্যামের শহরে এক ট্রিপ দেওয়ার পর আরেক ট্রিপ দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। ট্রিপ কম হলে জমার টাকা দিয়ে নিজের আয় নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকি। কারণ দিনে ট্রিপ দেওয়া যায় ৪টা। এর মাঝে যদি বিশ্রাম নিতে চাই, তাইলে তো সময়ই পাওয়া যাইব না। এমনিতে রাস্তার বেশির ভাগ জ্যামেই আটকায়া থাকি। কাজ শেষ করে বাসমালিককে জমার টাকা ফিরিয়ে দিতে দিতে মধ্যরাত হয়ে যায়। এভাবেই কেটে যায় ১৯ ঘণ্টা। মাঝেমধ্যে মনে হয়, এ কাজও ছেড়ে দিই, কিন্তু ছোট ভাইবোন আর বাবা-মায়ের মুখ চোখের সামনে ভাসলে দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাই।’

শুধু মাহাবুর নন। এই রুটে চলাচলকারী অছিম, আসমানি, রমজান ও স্বাধীন পরিবহনের ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল- সবার জীবনই কষ্টে মোড়ানো। কষ্ট কারো চেয়ে কারো কম না। গাড়িমালিকের শোষণ ও বঞ্চনায় হতাশার সাগরে ডুবে থেকেও যেন তাই ভুলে আছে তারা। মালিকরা আদায় করছেন দেড়-দুগুণ বাড়তি ভাড়া। প্রাপ্য বেতন না দিয়ে শ্রমিকদের শোষণ করা হচ্ছে। ঝুঁঁকিপূর্ণ শ্রম হলেও ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে ১১ থেকে ১৮-১৯ ঘণ্টা। তারপরও চলছে না তাদের পরিবার। অনেক ক্ষেত্রে ভাড়া না দিয়ে কমিশনের ওপর ছেড়ে দিয়ে শ্রমিকদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে না চিকিৎসার জন্য কোনো টাকাও।

ভালোলাগার কোনো বিষয় আছে কি না, জানতে চাইলে মাহাবুর বলেন, ‘মাঝেমধ্যে ভালোও লাগে। কারণ, অনেক ভালো মানুষও বাসে ওঠেন। তাদের কথা-উপদেশ শুনলে স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে, ভাবি- আবার পড়ালেখা শুরু করি, কিন্তু বাস্তবে তা আর সম্ভব না। বাবা-মা-ভাইবোনের মুখে হাসি ফোটাতেই দিন-রাত এক করে ফেলি। বাবা-মায়ের জন্য কিছু করতে পারা সবার ভাগ্যে জোটে না। আমি পারছি, এতেই আমার আনন্দ।’

ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী, জবাবে বলেন, ‘এখন আর এসব নিয়ে ভাবি না। স্বপ্ন-আশা মনে দাগ কাটে না। তবে বড় হয়ে গাড়ি চালানো শিখে ভালো চালক হতে চাই। সে বাসের হোক আর কোনো কোম্পানির বা কলেজের গাড়িরই হোক- এইটুকুই চাওয়া।’

ধূমপান কিংবা নেশাজাতীয় কোনো দ্রব্য সেবন করার বিষয়ে তার স্রেফ জবাব- ‘আই ডোন্ট লাইক দিস’। ‘বুঝেন-ই তো স্যার, এখানে এই বিষয়টা একেবারে এড়িয়ে চলা কঠিন চ্যালেঞ্জের। আমি এখানে এ পর্যন্ত ১০০ ভাগ সফল। কেউ আমাকে ওই পথে ডেকে নিতে পারেনি। আমি আমার মতো চলছি।’

পরিবহন শ্রমিকদের বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, গাড়িমালিকরা নানাভাবে তাদের শোষণ করে যাচ্ছেন। ন্যায্য অধিকার না দিয়ে অমানবিকভাবে বাড়তি রোজগারের হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। ৮ ঘণ্টার পরিবর্তে ঝুঁকিপূর্ণ এই শ্রমে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত খাটানো হচ্ছে। এটা চরম অমানবিক। কিন্তু মালিকরা নানা খোঁড়া অজুহাতে কেবল পুঁজির জোরে মানবতাকে লঙ্ঘন করছেন। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থান প্রয়োজন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close