নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ মে, ২০২৪

ভুল সিদ্ধান্তের ডেমু ট্রেনে গচ্চা ৬৫০ কোটি টাকা

রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না করেই কেনা ডেমু ট্রেনগুলো এখন রেলের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গচ্চা গেছে সরকারের ৬৫০ কোটি টাকা। মেরামতের সক্ষমতা না থাকায় ট্রেনগুলো দীর্ঘদিন পড়ে পড়ে ঘন জঙ্গলে ঢেকে গেছে; জং ধরে ক্ষয়ে পড়ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি। কোচ ও ইঞ্জিনসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণেরও উদ্যোগ নেই। ফলে ট্রেনগুলো স্থায়ীভাবে নষ্ট হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ট্রেনগুলো কেনার সিদ্ধান্তকেই ভুল আখ্যা দিয়ে খোদ রেলওয়ের মহাপরিচালক বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না করেই ট্রেনগুলো কিনে পুরো অর্থই জলে গেছে। আসলে ডেমু ক্রয় থেকে চলাচল শুরু পর্যন্ত পুরো বিষয়টিই হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে।

জানা যায়, ২০১৩ সালে স্বল্প দূরত্বের যাত্রীদের সেবা দিতে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে কেনা হয় ২০টি ডেমু ট্রেন। এর আগে ডেমু ট্রেন ক্রয়ে ২০১০ সালে রাজস্ব খাত থেকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়ে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পটি নাকচ করে দেয়। প্রস্তাবটিতে ডেমু ট্রেনের কোনো কামরায় এসি ছিল না, জানালা, টয়লেটও নেই। এতে বায়ু সঞ্চারের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। মূলত ট্রেনগুলো শীতপ্রধান দেশের জন্যই তৈরি হয়েছিল। ফলে তখন বাংলাদেশের উপযোগী নয় বলে সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পটির বিরোধিতা করেন। কিন্তু পরে ২০১০ সালের জুনে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ওই সময়ের পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং লিখিত চিঠি দিয়ে প্রকল্পটির অনুমোদন নেন।

সূত্র জানায়, ডেমু প্রকল্পের দরপত্রে অংশ নেওয়া তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চীনের দুটি এবং ইন্দোনেশিয়ার একটি ছিল। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র মূল্যায়নে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেওয়া হয়। এক কর্মকর্তা জানান, ‘রীতি অনুসারে দুটি প্রতিষ্ঠান অযোগ্য হওয়ায় পুনরায় দরপত্র আহ্বান করার কথা। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা কোম্পানিকে কাজটি দেওয়া হয়। সূত্র আরো জানায়, ডেমু কিনতে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করে ৮ কর্মকর্তাকে চীনে পাঠানো হয়েছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল ডেমুর কার্যকারিতা ও অন্য বিষয় দেখে আসা। এদের মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগের ৬ কর্মকর্তা এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ও পরিকল্পনা কমিশনের একজন করে কর্মকর্তা ছিলেন।

ঢাকা রেলওয়ে লোকোশেডে ঘুরে দেখা যায়, শেডের দক্ষিণ পাশে সারি সারি ডেমু পড়ে আছে। গাছপালা, লতাপাতায় ভরা জায়গাটি ভূতুড়ে পরিবেশ। শত শত কোটি টাকার ডেমুতে গাছপালা গজিয়ে গেছে। দরজা খোলা, ভেতরে মলমূত্রও চোখে পড়েছে। সিট এবং ডেমুর সামনের (ইঞ্জিন) অংশ ভাঙাচুরা। মাকড়সা আর মরিচা পড়া প্রতিটি ডেমুতে যেন পচন ধরেছে। একেকটি ডেমু সেটে দুটি করে ইঞ্জিন। বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনে উঠে দেখা গেছে, মাল্টি ডিসপ্লেগুলো ভাঙাচুরা-ছেঁড়া। যেন একেকটা ডেমুর কঙ্কাল। শেডে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তার ভাষ্য, ডেমুর কঙ্কালগুলো পড়ে আছে। তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে ডেমু থেকে যন্ত্রাংশগুলো হাওয়া হয়ে গেছে। এর জন্য দায়ী কে বা কারা, তা শনাক্ত করাও সম্ভব হবে। শেডটির ভেতর প্রায় ৭টি ডেমু পড়ে আছে। লতাপাতা আর গাছে ঢাকা বেশ কয়েকটি ডেমুর অংশ বিশেষ শুধু দেখা যাচ্ছিল। দক্ষিণ পাশের বিশাল এলাকাজুড়ে পড়ে থাকা ডেমুগুলোর উপরিভাগে শ্যাওলার আস্তর পড়েছে। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় ঘন জঙ্গলে ঢেকে গেছে ট্রেন; জং ধরে ক্ষয়ে পড়ছে মূল্যবান যন্ত্রপাতি। অবহেলা-অযত্নে ট্রেনগুলো এখন স্থায়ীভাবে নষ্টের পথে। কোচ ও ইঞ্জিনসহ গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলোও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই রেলের।

মেকানিকরা বলছেন, দেশে ডেমু মেরামতে নেই কোনো ওয়ার্কশপ; কোনো ট্রেনিংও দেওয়া হয়নি তাদের। ফলে প্রযুক্তিগত কোনো ধারণা না থাকায় ট্রেনগুলো মেরামত করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি ডেমুর যন্ত্রাংশও নেই দেশের বাজারে। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না করেই ডেমু কেনা হয় জানিয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, কেনার সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। ভবিষ্যতে কী প্রয়োজন হবে, সেই বিষয়টি তাদের ওই সময় বিবেচনা করা দরকার ছিল। তবে ব্যর্থতার দায়ভার কেউ নিতে না চাইলেও দেশীয় প্রযুক্তিতে ডেমু মেরামতের কথা ভাবছে রেল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা খরচ করে একটি ট্রেনও সচল করা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে সম্প্রতি রেলপথমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, ডেমু ট্রেন নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। তবে ট্রেনগুলো আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কেনা হয়নি। ফলে কেনাকাটা এবং ডেমু প্রশিক্ষণে বিদেশে যেসব কর্মকর্তা গিয়েছিলেন, তাদের বিষয়েও আমি জানি না। তবে জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন। এখন অকেজো ডেমুগুলোর কী হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ডেমু বিষয়ে আমি খুব একটা জানি না। তবে এ বিষয়ে আমি খোঁজ নেব।

রেলপথ সচিব ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, এখন ডেমু সেভাবে চলছে না। এটি যাত্রীবান্ধব হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে তা হয়নি। ডেমুর বর্তমান অবস্থান নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। আলোচনার পর নির্ধারণ করা হবে এ বিষয়ে কী করা যায়। এছাড়া ডেমু ক্রয় এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিল, তাদের অবস্থান আমার জানা নেই। এ প্রকল্পে যারা বিদেশে গিয়েছিলেন, নিশ্চয় তাদের জবাবদিহি থাকবে। জবাবদিহি থাকা প্রয়োজন।

জানা গেছে, স্থানীয়ভাবে একটি ডেমু মেরামত করে কিছু দিন চালানো হয়েছে। রেলের সাবেক প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান ২০২২ সালে একটি ডেমু মেরামত করেন। প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ করে মেরামত করা একটি ডেমু লালমনিরহাট সেকশনে কিছু দিন চালানোও হয়। পরে সেটি চূড়ান্তভাবে অচল হয়ে পড়ে। সে সময় বলা হয়েছিল দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্য ট্রেনগুলোও মেরামত করা সম্ভব। কিন্তু সংস্কারের কিছু দিন পর ট্রেনটি বসে গেলে বাকিগুলোর পেছনে আর অর্থ ব্যয় করা হয়নি।

পূর্বাঞ্চল রেলের বিভাগীয় যান্ত্রিক প্রকৌশলী সাজিদ হাসান নির্ঝর বলেন, ডেমু ট্রেনের প্রায় সবকটি অকেজো হয়ে আছে। একটি ডেমু চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত চলাচল করে তাও একদিন চললে ২ দিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। এটিও চূড়ান্তভাবে অচল হয়ে পড়বে। দিন দিন এগুলো ধ্বংস হচ্ছে। এখন কোনো অবস্থাতেই মেরামত করা সম্ভব নয়। তাছাড়া ডেমুর মালামাল স্থানীয়ভাবে কোথাও পাওয়া যায় না। চীন এগুলো একটি বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে চালাত। ওই সফটওয়্যারও নেই। চীন থেকে আসা সংশ্লিষ্টরা কয়েক বছর পরই চলে গেছেন। এখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা পেলে ডেমুগুলো নিলামে বিক্রি করা যেতে পারে।

রেলের সাবেক মহাপরিচালক মো. আবু তাহের বলেন, আমি যখন ছিলাম তখন ডেমু দেশে এসেছে। ডেমু গ্রহণ করেছে মেকানিক্যাল দপ্তরের কর্মকর্তারা। ডেমু ক্রয়ের পুরো বিষয়টি আগেই সম্পন্ন হয়েছিল। যখন ডেমু চালানো হলো তখন যাত্রীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কারণ ডেমু ছিল নন-এসি। কিন্তু পুরো ডেমুর দরজা বন্ধ অবস্থায় চালানো হতো। জানালা ছিল না। ছিল না টয়লেট। ভেতরে ফ্যানও ছিল না। প্রচণ্ড গরমে যাত্রীরা অসুস্থ হয়ে পড়তেন। তাছাড়া ডেমু কেনার পরও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ছিল না ওয়ার্কশপ-দক্ষ জনবলও। বলা যায়, ডেমু ক্রয় থেকে চলাচল শুরু পর্যন্ত পুরো সময়েই অনিয়ম-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে গেছে। পুরো অর্থটাই জলে গেছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম সামছুল হক বলেন, ডেমু ক্রয় পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বিদেশে যাওয়া কর্মকর্তা এবং বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এর দায় এড়াতে পারেন না। সরকারি অর্থ মানেই সাধারণ জনগণের অর্থ। ৬৫০ কোটি টাকা একেবারেই কাজে এলো না। এজন্য প্ল্যানিং কমিশন থেকে শুরু করে রেলপথ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরে এ প্রকল্পে জড়িতদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়া দরকার। তাহলে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এমন প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সবাই সতর্ক থাকবে।

ড. সামছুল হক আরো বলেন, দেশে যুগের পর যুগ ধরে ইঞ্জিন-কোচ চলছে, আর ডেমু মাত্র কয়েক বছরেই ধ্বংস হয়ে গেল। কেনাকাটার মূল শর্ত যদি হয়-ভালো পণ্য বুঝে নেওয়া, তাহলে সংশ্লিষ্টরা কী করলেন। দায়ীদের বিরুদ্ধে প্ল্যানিং কমিশন কিংবা রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close