বিশেষ প্রতিনিধি

  ২০ মে, ২০২৪

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ নিয়ে রাজনীতি!

* রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ১২ লাখ, সারা দেশে ৬০ লাখ * প্রায় ১৫% দুর্ঘটনায় যুক্ত এসব অটো * অভিযানের ফলে বেশকিছু সড়কে স্বস্তি * অভিযানের বিরুদ্ধে প্রাণপণে মাঠে চালকরা * বিকল্প পরিবহনের দাবি কিছু রুটের যাত্রীর

রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলা আনা ও প্রাণহানি কমাতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য পর পর দুদিন অভিযানও চলে স্থানে স্থানে। সড়ক নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য সহায়ক হবে। অভিযানের ফলে গতকাল রবিবার দেখা গেছে, রাজধানীর মিরপুরসহ বিভিন্ন স্থানে যানজট কমেছে, বিশৃঙ্খলাও কমেছে। কিন্তু চালকরা বিকল্প ব্যবস্থার দাবি তুলেন। দিনভর প্রতিবাদ করেন। পুলিশ ও চালকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, এ অবৈধ যানবাহনের সংখ্যা সবার চোখের সামনে বেড়েছে। হঠাৎ বন্ধের সিদ্ধান্তে সমূলে উৎপাটন করা যাবে না। এজন্য সীমিত পরিসরে যানবাহন চলতে দিয়ে এক সময় তা বন্ধ করে দিতে হবে। সড়কে প্রাণহাণীর জন্য দায়ী এসব যানবাহন বন্ধ করার উদ্যোগ নিলেই বিভিন্ন পক্ষ থেকে রাজনীতি শুরু হয়। এ রাজনীতিও বন্ধ করতে হবে। কারণ যেসব চালক পুলিশের সঙ্গে মারামারি করেছে তাদেরকে সরকারবিরোধী একটি পক্ষ ইন্ধন দিয়েছে।

গত ১৫ মে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সদর কার্যালয়ে সড়ক উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ‘ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্ত হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ওই যান বন্ধের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, সারা দেশে মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে এবং এসব যানবাহনে হতাহতের হার বেশি। ঢাকা শহরে কোনো ব্যাটারিচালিত থ্রিহুইলার চলবে না। এর আগে আমরা ২২টি হাইওয়েতে এটি নিষিদ্ধ করেছিলাম। কাদের বলেন, এবার এসব থ্রিহুইলার যাতে শহরের রাস্তায় চলতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।

একটি বেসরকারি সংস্থার হিসাবে, ২০২৩ সালে ৮ হাজার ৫৫টি যানবাহন দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল। তার মধ্যে ১৪.৪৭ শতাংশ ছিল ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং ইজিবাইক।

সড়ক উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর তিন চাকার এই যান চলাচল বন্ধে বিজ্ঞপ্তি দেয় বিআরটিএ। পুলিশ অভিযানও শুরু করে। রাজধানীতে গতকাল রবিবার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে পুলিশ আরো তৎপর থাকে। পুলিশের এই অভিযান তৎপরতার প্রতিবাদে সকালে রাজধানীর মিরপুরসহ বেশকিছু স্থানে চালকরা বিক্ষোভ করে। বিকেলে মিরপুরের কালশীতে ট্রাফিক পুলিশের বক্সে আগুন লাগিয়ে দেয় অটোরিকশা চালকরা। এর আগে পুলিশের সঙ্গে চালকদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত কয়েক দিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এই অভিযানে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল বন্ধ হয়েছে। এর ফলে অনেকাংশে যানজট কমেছে। এতে গতকাল অফিসগামী মানুষ যানজটমুক্ত পরিবেশে অফিসে যাতায়াত করতে পেরেছেন।

রাজধানীর পল্টন থেকে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে করে ২২ মিনিটে শংকর পৌঁছাতে পারেন সোয়েব আহমেদ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বলেন, ব্যাটারিচালিত অটো চলাচল বন্ধ হওয়ায় এই সুফল পাচ্ছি। ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি রিকশার কারণে মৌচাক, রামপুরা, বাড্ডা, গুলিস্তান ও নিউমার্কেট এলাকায় যানজট লেগেই থাকে। গতকাল এসব সড়কে তেমন কোনো যানজট ছিল না। তিনি আরো বলেন, এই রাস্তায় দিয়ে অফিসে আসতে কমপক্ষে ৪০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা সময় লাগত।

তবে কিছু রুটে বিকল্প বাহনের ব্যবস্থা না থাকায় যাত্রীরা বিপাকে পড়েন। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ হওয়ায় প্যাডেল রিকশা ৩০ টাকার পরিবর্তে ৭০ টাকা ভাড়া আদায় করে। খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ি থেকে রিকশাযোগে প্রতিদিনই কর্মস্থলে যান শহিদুল্লাহ শহিদ। তিনি বলেন, আজ (গতকাল) রিকশা না থাকায় কিছুটা পথ বাসে করে, আর কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হয়েছে। রিকশা বন্ধ করার নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে বিকল্প বাহনের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অনেক এলাকা আছে, যেখানে গণপরিবহন চলে না। সেখানে যাওয়ার একমাত্র বাহন হচ্ছে রিকশা, সিএনজি ও ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল। এখন বিকল্প কোনো বাহনের ব্যবস্থা না করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বন্ধ করতে পারেন না।

সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় গতকাল বিকেলে কালশী মোড়ে অবস্থিত ট্রাফিক পুলিশের বক্সে আগুন দিয়েছে আন্দোলনরত অটোরিকশা চালকরা। পল্লবী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেসুর রহমান বলেন, কালশীতে অটোরিকশার চালকরা সহিংস আন্দোলন করছে। তারা কালশী মোড়ের পুলিশ বক্সে আগুন দিয়েছে। আমরা ঘটনাস্থলে আছি, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছি। এর আগে অটোরিকশা চালকরা এ সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। মিরপুর বেনারসী পল্লীর ৪ নম্বর সড়কে অটোরিকশা চালকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে কয়েকটি গাড়িও ভাঙচুর করেন অটোচালকরা। এ সময় বাসে থাকা যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে বাস থেকে নেমে পড়েন।

দুপুর সোয়া ১টার দিকে অটোরিকশা চালকরা কালশী সড়ক আটকে দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় অনেকের হাতে লাঠি দেখা যায়। তারা গাড়ি ভাঙচুর করতেও উদ্যত হয়। সড়কের মাঝখানে রশি টানিয়ে দিয়ে যানচলাচল বন্ধ করে দেয় তারা। এক পর্যায়ে সড়কে আড়াআড়িভাবে বাস রাখতে চালকদের বাধ্য করেন। এতে ওই সড়ক ব্যবহারকারী হাজার হাজার যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েন। গন্তব্যে যেতে মানুষকে হেঁটে রওনা দিতে দেখা যায়।

মিরপুর-১০, ১১, ১২, টেকনিক্যাল, আগারগাঁও, সরকারি বাঙলা কলেজ, মাটিকাটা, বাড্ডা, তালতলা ও বাসাবো এলাকার বিভিন্ন সড়কে হাতে লাঠি নিয়ে সড়ক অবরোধ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা। গতকাল সকাল পৌনে ১০টার দিকে মিরপুর সাড়ে ১১ ও মিরপুর ১০ নম্বর সড়কে বিক্ষোভ করেন তারা।

মিরপুর ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার জসিম উদ্দিন জানান, আজ (গতকাল) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর-১১, মিরপুর-১, আগারগাঁও ও কালশী এলাকায় কয়েকশ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালক জড়ো হয়ে সড়কে বিক্ষোভ করেন। বিক্ষোভকারীরা যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।

খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের সামনে বিক্ষোভকারী অটোরিকশা চালক ফুলমিয়া বলেন, এসব রিকশার মালিক তো আমরা নই, বিভিন্ন প্রভাবশালী এসব বাহনের মালিক। আমরা দিন চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে চালাই। সরকার যদি এসব বাহন বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমরা কই যাব। তিনি বলেন, হঠাৎ এসব রিকশা বন্ধ করে দিলে আমাদের পরিবার কীভাবে চলবে, কী খেয়ে থাকবে?

রাজধানীর অলিগলি ও মূল সড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ১২ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইক। হাইকোর্টের তিন দফা নির্দেশনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞার পরও এগুলো বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০১৯ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ১১ লাখের বেশি প্যাডেল রিকশা এবং ২ লাখের বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে।

পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার হিসেবে রাজথধানী ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে। এসব রিকশার ব্যাটারি চার্জে দিনে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যয় হয়ে থাকে। তার অধিকাংশই অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে দেওয়া হয়। তাতে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে।

একটি রিকশা প্রতিদিন চার্জ বাবদ খরচ হচ্ছে ৫ ইউনিট বিদ্যুৎ। ৯০ শতাংশ গ্যারেজে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ বিদ্যুৎ।

রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চালক সংগ্রাম পরিষদ অবশ্য বলছে, এই সংখ্যা ১২ লাখের বেশি। রাজধানীর মিরপুর, পল্লবী, মুগদা, বাসাবো, হাজারীবাগ, জিগাতলা, কামরাঙ্গীরচর, দক্ষিণখান, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, বাড্ডা, জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, শনিরআখড়া, বাসাবো, মাদারটেকসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা বেশি চলাচল করে থাকে।

ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে বিআরটিএ’র নির্দেশনা না মানলে ব্যবস্থা : ঢাকার সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান এবং এ ধরনের তিন চাকার যান চলাচল বন্ধে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ।

শনিবার প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বিআরটিএ বলছে, ব্যাটারি বা মোটরচালিত রিকশা বা ভ্যান বা এ জাতীয় থ্রিহুইলার ঢাকা মহানগরীতে চলাচলের কারণে সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী ব্যাটারি/রিকশা বা ভ্যান বা এ ধরনের থ্রিহুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ অবস্থায় ঢাকা মহানগরীতে ব্যাটারি/রিকশা বা ভ্যান বা এ ধরনের থ্রিহুইলার এবং ফিটনেসের অনুপযোগী, রংচটা, জরাজীর্ণ ও লক্কড়ঝক্কড় মোটরযান চালানো বন্ধ করার অনুরোধ করা যাচ্ছে। নির্দেশনা অমান্য করলে সংশ্লিষ্টের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে বিআরটিএ।

এদিকে রাজধানীতে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি দিয়েছে রিকশা, ব্যাটারি রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদ। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্মসূচির কথা জানায় সংগঠনটি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close