নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১০ মে, ২০২৪

আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ তিনজনের যাবজ্জীবন

মসজিদ-ক্লাবের দ্বন্দ্বে খুন হন সোহেল

১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোর। রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে অবস্থিত ট্রাম্প ক্লাবের নিচে উপুড় হয়ে থাকা একটি মরদেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। রক্তের ছাপ শুরু হয়েছিল ক্লাবের সিঁড়ির সামনে থেকে। উপুড় হয়ে থাকা দেহটি যখন ঘোরানো হয়, তখন পরিচিত মুখটি অনেকেই আঁতকে ওঠেন। অনেকেরই চেনা এই মুখ। তিনি আর কেউ ছিলেন না, তিনি ছিলেন ওই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক সোহেল চৌধুরী। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় এ অভিনেতার। বিয়ে করেছিলেন আরেক জনপ্রিয় তারকা পারভীন সুলতানা দিতিকে। যদিও পরে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। দেশজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল সোহেল চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড ঘিরে। সেই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষিত হলো গতকাল বৃহস্পতিবার।

আদালত নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যায় আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অপর দুজন হলেন- ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আদনান সিদ্দিকী। দণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামিই পলাতক। খালাস পেয়েছেন ৬ জন। এরা হলেন- আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন, ফারুক আব্বাসী, সেলিম খান ও হারুন-অর-রশিদ ওরফে লেদার লিটন। তাদের মধ্যে ইমন জেল হেফাজতে এবং আশীষ রায় চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন ও ফারুক আব্বাসী জামিনে আছেন। কিন্তু রায়ের সময় মামুন ও ফারুক তাদের আইনজীবীদের মাধ্যমে আবেদন জমা দিয়ে আদালতে অনুপস্থিত ছিলেন।

সাক্ষীরা গা বাঁচিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন : রায়ে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সোহেল চৌধুরী কোনো অখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না। সোহেল চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সাক্ষীরা সত্য গোপনের চেষ্টা করেছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর পূর্বশত্রুতা ছিল। সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। মানুষ তো অসীমকাল বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আত্মা বিচার চায়। আদালত আরো বলেন, আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই আদনান সিদ্দিকী ও বান্টি ইসলাম খুনের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ হয়েছে। এ তিন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

ক্লাব আর মসজিদের দ্বন্দ্ব : বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের পশ্চিম পাশে ছিল একটি জামে মসজিদ। ওই ক্লাবে নাচণ্ডগানসহ অসামাজিক কার্যকলাপ চলত। ক্লাবের অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধে স্থানীয় মুসল্লিদের পক্ষে অবস্থান নেন সোহেল চৌধুরী। তিনি মসজিদ কমিটির লোকজন নিয়ে ক্লাব বন্ধ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ব্যর্থ হন। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝামেলা হয়। ট্রাম্প ক্লাবের কাজ ব্যাহত হলে সোহেল চৌধুরীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন আসামিরা। ২৪ জুলাই রাত। সোহেল চৌধুরী ও তার কয়েকজন বন্ধু সেই ক্লাবে যান। সেখানে বিতর্কিত ধনকুবের আজিজ মোহাম্মদ ভাইও ছিলেন। সেদিন রাতে বনানীর ট্রাম্প ক্লাবে গান বন্ধ করতে বলেছিলেন সোহেল চৌধুরী ও তার বন্ধুরা। এ নিয়ে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেলের কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে সোহেল চৌধুরী আজিজের ওপর ক্ষেপে যান। তখন সোহেলের বন্ধু কালা নাসির গুলি করতে যান আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে। এ সময় ক্লাবের শৌচাগারে ঢুকে আত্মরক্ষা করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই। এ ট্রাম্প ক্লাবের মালিকানা ছিল বান্টি ইসলাম ও আশীষ চৌধুরীর। সোহেলের বন্ধু গোলাম মোহাম্মদ বলেছিলেন, খুন হওয়ার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর ঝগড়া হয়। বিষয়টি তার সামনে ঘটেছিল। এছাড়া ট্রাম্প ক্লাবের বান্টি ইসলামের সঙ্গে সোহেলের দুই থেকে তিনবার ঝগড়া হয়। পরে তা মিটেও যায়। তবে আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি এড়ানো যায়নি। আশীষ চৌধুরীই সোহেল চৌধুরীকে ক্লাব থেকে বের করে দেন। ভবিষ্যতে সোহেলকে ক্লাবে না আসার জন্য হুমকিও দেন।

যেভাবে হত্যা করা হয় : সোহেল চৌধুরীকে হত্যার বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরে সোহেল চৌধুরী ক্লাবে ঢুকতে চেয়েছিলেন। তবে তাকে ক্লাবে ঢোকার অনুমতি না দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে রাত ৩টার দিকে সোহেল চৌধুরী আবার ক্লাবের সামনে আসেন। তখন পেশাদার খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মামলার সাক্ষী আবুল কালাম পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, সেদিন সোহেলসহ সাত থেকে আটজন লোক ক্লাবের সামনে গেলে হঠাৎ গুলি করা হয়। সোহেল চৌধুরীর পেটে গুলি লাগে। তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। সন্ত্রাসীদের গুলিতে সেদিন গুলিবিদ্ধ হন নীরব ও দাইয়ান নামে আরো দুজন। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী-সাক্ষী জবানবন্দিতে বলেন, ১৯৯৮ সালের ২৪ জুলাইয়ের একটি ঘটনা থেকে আজিজ মোহাম্মদ ভাই, আজিজের আত্মীয় বান্টি ইসলাম, বান্টির বন্ধু আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে সোহেলের বিরোধের শুরু। এর জেরেই ট্রাম্প ক্লাবের সামনে ভাড়াটে লোক দিয়ে হত্যা করা হয় সোহেল চৌধুরীকে।

হত্যার আগে হুমকি : সোহেল চৌধুরী হত্যা নিয়ে তার মা নূরজাহান বেগম আদালতকে বলেন, সোহেল খুন হওয়ার ১৫ থেকে ২০ দিন আগে টেলিফোনে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও বান্টি ইসলামের লোকজন হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, সোহেলের মৃত্যুর দিন ঘনিয়ে আসছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close