গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩০ জুন, ২০২২

অলস ফেরি, আর্থিক ক্ষতির মুখে বিআইডব্লিউটিসি

স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে। কম সময়ে গন্তব্যে ফিরতে ওই অঞ্চলের মানুষ বেছে নিয়েছে এ সেতুকে। দীর্ঘ যানজট এড়াতে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া এবং মুন্সীগঞ্জের মাওয়া-মাঝিরকান্দি নৌপথ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে ট্রাক-বাস থেকে শুরু করে ছোট যানবাহনগুলো। এতে গাড়ির চাপ কমেছে নৌপথে। ফলে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিসি)।

গত ২৫ জুন চালু হয় পদ্মা সেতু। এরপর থেকে মাওয়া-মাঝিরকান্দি রুটে বিআইডব্লিউটিসির ফেরিগুলো অলস পড়ে আছে। সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলে ২৭ জুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে সেতু কর্তৃপক্ষ। এতে বিপাকে পড়ে মোটরসাইকেল চালকরা। ফলে সেদিন পদ্মা নদী পাড়ি দিতে ফেরিকে বেছে নেয় মোটরসাইকেল চালকরা। কিন্তু মোটরসাইকেল পারাপারে ফেরি সার্ভিস দিতে গিয়ে উল্টো ক্ষতির মুখে পড়ে কর্তৃপক্ষ। কারণ প্রতি ট্রিপে প্রতিটি ১০০ টাকা হিসেবে একত্রে ২০০ মোটরসাইকেল পারাপারে ২০ হাজার টাকা আয় হলেও জ্বালানির পেছনে ফেরি কর্তৃপক্ষতে গুনতে হয়েছে ৩০ হাজার টাকার মতো। এরপর এক দিনও চলেনি এ রুটের ফেরিগুলো। গতকাল বুধবারও ছিল না ফেরি পথে যানবাহন এবং যাত্রী। এতে দৈনিক সংস্থাটির আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ১৪ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা।

এদিকে, বিআইডব্লিউটিসির বড় আয়ের আরেকটি রুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট। সেতু ব্যবহার করে যানবাহন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আসা-যাওয়া করায় আর্থিকভাবে বড় ধাক্কা পড়েছে সংস্থাটির ওপরে। এই রুটে দৈনিক ৮০ লাখ থেকে ৮৫ লাখ টাকা আয় হলেও বর্তমানে আয় হচ্ছে ৬০ লাখ থেকে ৬৫ লাখ টাকা। এখানেও আয় কমেছে ২০ শতাংশ। অথচ বিআইডব্লিউটিসির আয়ের প্রধান উৎস এই ফেরিই। কিন্তু পদ্মা সেতুর ওপর যানবাহনের নির্ভরশীলতা না কমলে স্বশায়িত এই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন জোগানোই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে- এমন আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। তারা আশা করছেন, পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলে মানুষের উৎসাহ এক মাসের মধ্যে কিছুটা কমে আসবে। কারণ সেতুর দু’পাড়ের সংযোগ সড়কে টোল ধার্য করা হলে অতিরিক্ত ব্যয় এড়াতে যানবাহন ফেরিতেও পারাপার হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, গত ১৬ জুন থেকে পদ্মা সেতুর ধার্য টোলের সঙ্গে সমন্বয় করে ফেরি পারাপারে বিদ্যমান ভাড়ার সঙ্গে ২০ শতাংশ যোগ করে ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়। এ ভাড়া বৃদ্ধি না করলে আরো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হতো বিআইডব্লিউটিসিকে।

এদিকে নৌ-মন্ত্রণালয় নতুন নতুন নৌ-রুট ও পথের সন্ধানে জরিপ চালাচ্ছে। এতে ব্যয় হচ্ছে সংস্থাটির। বাণিজ্যিক পর্যায়ে না পৌঁছানো পর্যন্ত লাভজনক ব্যবসা থেকে বিনিয়োগ জোগাতে হবে সংস্থাকে। এসব বিষয়ে সংস্থার দুটি কারিগরি টিম দেশের উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শন করছে। আগামী ডিসেম্বরে বর্তমানে ৫১টি ফেরির সঙ্গে আরো ১২টি ফেরি যোগ হবে। এসব ফেরি নতুন রুটে চালু করার চিন্তা। এখান থেকে আয় দিয়েই সংস্থার কার্যক্রম সচল রাখতে সক্ষম হবেন এমন প্রত্যাশা কর্তৃপক্ষের।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আহমেদ শামীম আল রাজি প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হবে এটা আগে থেকেই জানতাম। চালু হলে ফেরি বন্ধ হয়ে যাবে। বিকল্প হিসেবে ভাবনা শুরু হয়েছে। যথেষ্ট আগে ভাবলে আরো ভালো হতো। এখন আমরা সম্ভাব্য কয়েকটি জায়গা তালিকাভুক্ত করেছি। এ তালিকা অনুযায়ী দুটি টিম কাজ করছে। তারা সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখছে। সম্ভাব্য রুটের নাব্যতা, গম্যতা এবং যানবাহন চলাচল কি পরিমাণ বাড়বে সব বাণিজ্যিক দিকগুলোও সমীক্ষা করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, সেতু চালুর পর মাওয়া রুটে ফেরিতে যানবহন পারাপার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আর পাটুরিয়া দৌলতদিয়া ঘাটের বেশ কিছু গাড়ি পদ্মা সেতুর দিকে চলে যাচ্ছে। এ রুটে ৪০ শতাংশ গাড়ি কমে গেছে। গাড়ি কমে যাওয়া মানেই আয়ও কমে যাওয়া। তবে এই ৪০ শতাংশ চাপ কমে যাওয়াটাও সাময়িক। কারণ সেতু নতুন উদ্বোধন হওয়ার কারণে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে ওই পথকে অনেকেই বেছে নিয়েছেন। পরে তারা পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দিয়েই যাবেন এটা আশা করছি। ক্ষতির বিষয়টি কিংবা দীর্ঘস্থায়ী সংকটে বিআইডব্লিউটিসি পড়বে কি না এজন্য ন্যূনতম একমাস পর্যবেক্ষণ করছি।

তিনি বলেন, এই দুটি ঘাটে চাপ কমলেও আরিচা-কাজিরহাট ঘাটে এবং চাঁদপুর-শরীয়তপুরে গাড়ির চাপ বেড়েছে। সেখানে আমাদের বাড়তি ফেরি দিতে হচ্ছে। সামনে কোরবানির ঈদ এ সময়ে বাড়তি চাপ থাকবে। সব মিলিয়ে আমাদের তৎপরতা একেবারে কমে গেছে এমন না। এখন বরং আমরা উপকূলীয় এলাকায় চলে যাব। সম্প্রতি সন্দ্বীপে একটা টিম গিয়েছিল। আরেকটি টিম বরগুনা ও পটুয়াখালী যাবে। এ ছাড়া আমি নিজেই ঘুরে এসেছি রৌমারী-চিলমারী এলাকায়। রৌমারীতে রাস্তা হয়েছে। অন্য পাড়েও রাস্তার কাজ চলছে। এখানে নাব্যতা অল্প, সেটা কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রাথমিক গণশিক্ষামন্ত্রী খুবই সহযোগিতা করছেন এ কাজে।

বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান আরো বলেন, রৌমারী-চিলমারী ছাড়াও বালাসী-বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি-মাদারগঞ্জ, জৌপুরা-নাজিরগঞ্জ, হাতিয়া-সন্দ্বীপ-নোয়াখালী, চট্টগ্রামণ্ডসন্দ্বীপ এবং ভোলা-পটুয়াখালী রুটগুলোতে আমাদের বিনিয়োগ করতে হচ্ছে। এগুলো চালু হলেও আয় আসতে সময় লাগবে।

প্রশাসন সার্ভিসের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, পদ্মার মাওয়া-মাঝিরকান্দি এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্টে দৈনিক এক কোটি টাকার বেশি আয় হতো। বর্তমানে তা কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ প্রতিষ্ঠানের লাভজনক বাণিজ্যিক ক্ষেত্র ফেরি। তাই হঠাৎ আয় সীমিত হয়ে আসায় প্রতিষ্ঠানের ওপরে কিছুটা চাপ পড়বে- এটা স্বাভাবিক।

বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্যিক) এস এম আশিকুর রহমান প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আর্থিক বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। অন্তত ১৫ দিন যাক, এরপর আয়ের ক্ষেত্রে উন্নতি না ঘটলে বিকল্প চিন্তা শুরু করব। এ ছাড়া আপাতত আমাদের কিছু করণীয় নেই।

এসব বিষয়ে বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় (২৮ জুন সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত) ৫ হাজার ৪০০ গাড়ি দু’প্রান্ত থেকে আসা-যাওয়া করেছে। আগে দৈনিক যানবাহন পারাপারের সংখ্যা ছিল ৭ হাজার থেকে সাড়ে ৭ হাজার। সেতু চালুর পর ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজারের মধ্যে রয়েছে। আগে এই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া রুটে দৈনিক আয় ছিল ৮০ লাখ থেকে ৮৫ লাখ টাকা। বর্তমানে এ আয় কমে ৬০ লাখ থেকে ৬৫ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ছোটগাড়ির সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। কমেছে ট্রাকের সংখ্যা। একইভাবে পরিবহনের সংখ্যাও কিছু কমেছে। আগে ট্রাক দেড় হাজারের ওপরে পার হলেও এখন ৯০০-১০০০টি পার হচ্ছে। এভাবেই আয় কমেছে। সবকিছুই আমরা খতিয়ে দেখছি। পর্যবেক্ষণ করছি। আর সর্বোপরি উন্নতি না হলে বিকল্প রুট তো খোঁজা হচ্ছেই।

বিআইডব্লিউটিসির মাওয়া শিমুলিয়া ফেরিঘাটের সহ-উপমহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো. শফিকুল ইসলাম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ২৫ জুনের পর থেকে মাওয়া-মাঝিরকান্দি ফেরিঘাট বলা যায় অচল। গাড়িও আসে না, ফেরিও চলে না। মাঝে গত ২৭ জুন শুধু মোটরসাইকেল নিয়ে ফেরি চলেছে। এতে ফেরির জ্বালানি খরচ উঠে না। কারণ একটি মোটরসাইকেলের ভাড়া মাত্র ১০০ টাকা; এক ট্রিপে ফেরিতে ২০০ মোটরসাইকেল ধরে। প্রতি ট্রিপে ২০ হাজার টাকা আয় হলেও একটি ফেরিতে জ্বালানিতে ব্যয় আছে ৩০ হাজার টাকার ওপরে। তিনি আরো বলেন, সকাল থেকে এই ঘাটে কোনো যানবাহন আসেনি; এমনকি কোনো পণ্যবাহী পিকাপ, ট্রাকও আসেনি। এই ঘাটের ইতিহাসে এটা বিরল ঘটনা। কোনো ঘাট থেকে ফেরি ছেড়ে যায়নি। তবে চলাচলের জন্য প্রস্তুত আছে ৫টি ফেরি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close