ডা. মুশতাক হোসেন

  ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

স্মরণ

পতাকায় সোনারঙের বাংলাদেশ ও আমাদের শিবুদা

অট্টহাসিতে চারদিক মাতিয়ে রাখা প্রাণচঞ্চল শিবুদা চিরবিশ্রামে চলে গেলেন গত শুক্রবার। নিশ্চিত করে বলতে পারি, যিনি তার সঙ্গে একবার কথা বলেছেন, তিনি কখনোই শিবুদাকে ভুলতে পারবেন না। শিবুদার অন্যান্য পরিচয় ছাপিয়ে আজ যে পরিচয় সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম পতাকায় তার হাতের ছোঁয়ায় বাংলাদেশের মানচিত্র ভাস্বর হয়ে উঠেছিল। শিবুদাকে কেন এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব দিলেন স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের নেতারা? কারণ তিনি ছিলেন সেই নিউক্লিয়াসের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক, যিনি গোপনীয়তা বজায় রাখবেন জীবন দিয়ে। তবে তাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে শিবনারায়ণ দাসের শিবুদা হয়ে ওঠার গল্পটা জানতে হবে।

কুমিল্লার সতীশ চন্দ্র দাসের ছেলে শিবনারায়ণ দাসের জন্ম হয় ১৯৪৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কী আশ্চর্য যোগাযোগ! শিবনারায়ণ দাসের ২৫তম জন্মদিনে বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ বিজয়ী হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার উষালগ্নে সতীশ চন্দ্র দাসকে যখন হত্যা করা হয়, তখন শিবনারায়ণ দাস রণাঙ্গনে হত্যাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত।

কুমিল্লার আরেক কৃতী সন্তান ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের অনুপ্রেরণায় শিবনারায়ণ দাস ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পরপরই। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৬৯ সালে। তথাকথিত লৌহমানব আইউব খানের বিরুদ্ধে জানবাজি ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান রচিত হয় এ বছরেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ শেষে স্বাধীন বাংলাদেশেও তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দায়িত্ব অব্যাহত রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার নবতর সংগ্রামে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সৃষ্টিতে শিবনারায়ণ দাসের ভূমিকা সিরাজুল আলম খানের জবানিতেই শোনা যাক। ‘স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম এবং আগামীর বাংলাদেশ’ বইয়ে [অঙ্কুর প্রকাশনী। ২০১৯। পৃষ্ঠা ৭৮-৭৯] তিনি লিখেছেন :

‘... ... ১৯৭০-এর ৬ জুন সন্ধ্যায় ইকবাল হলের (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাজাহান সিরাজ ও আ স ম আবদুর রবকে ডেকে কাজী আরেফ “নিউক্লিয়াস”-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানান। ... ... পতাকা সেলাই করে আনার পর সমস্যা হয় এর মাঝখানে সোনালি মানচিত্র আঁকা নিয়ে। কীভাবে কাকে দিয়ে সেই সোনালি রঙের মানচিত্র আঁকা যায়? এ সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাসকে (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে ডেকে আনা হয়। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নম্বর কক্ষে। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হয় বাংলাদেশের মানচিত্র। সোনালি রং কিনে আনা হয়। শিবনারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশালাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রং। শিবনারায়ণ দাসের কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটি ভবিষ্যতের নতুন দেশের “নতুন পতাকা”র জন্ম হয়।’ বাঙালির স্বপ্নের সে পতাকা ১৯৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আহূত লাখ লাখ জনতার সামনে উত্তোলন করেন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব।

স্বাধীনতার আগে ও পরে ষাট ও সত্তর দশকে ছাত্রলীগের উদ্যোগে যতগুলো একুশের স্মরণিকা প্রকাশিত হতো, তার মধ্যে শিবুদার সম্পাদিত স্মরণিকাগুলোই হতো সবচেয়ে ভালো। কারণ প্রচ্ছদ ও অলংকরণের কাজ শিবুদাই করতেন। অন্যান্য সম্পাদনার কাজ তো ছিলই।

স্বাধীনতার পরে আমি শিবুদাকে দেখি, তবে সরাসরি কথা হয়েছে অনেক পরে। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে জাসদ অফিসে, গণকণ্ঠ অফিসে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হল ও নজরুল ইসলাম হলের ক্যানটিনে তাকে দেখতাম। তিনি খুব জোরে কথা বলতেন, আর আসর জমিয়ে ফেলতেন অল্প সময়েই। ১৯৮০ সালে জাসদণ্ডবাসদ বিভক্তি, ১৯৮৩ সালে জাসদে এরশাদের পক্ষে-বিপক্ষে বিভক্তির পরিপ্রেক্ষিতে শিবুদা অন্য অনেক প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা-সংগঠকের মতো দলীয় কাজে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। তবে কর্নেল তাহের সংসদে তিনি সক্রিয় ছিলেন। ১৯৯৭ সালে জাসদণ্ডবাসদের বিভিন্ন অংশ ঐক্যবদ্ধ হলে শিবুদা আবার সক্রিয় হন। তবে শিবুদা ছিলেন চির বিদ্রোহী। ঐক্যবদ্ধ জাসদে তিনি নেতৃত্বের কঠোর সমালোচক ছিলেন। ফলে তাকে নেতৃত্বের রোষানলে পড়তে হয়। রাজনীতিতে আবার তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে যান।

স্বাধীনতার পতাকা গড়ে ওঠার বিষয়টি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ঔৎসুক্য সৃষ্টি করলে তিনি আবার দৃশ্যপটে চলে আসেন। তবে সাংবাদিক ও গবেষকরা তাকে শুধু পতাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ফেলতেন। তিনি বলতেন, আমি কি শুধু পতাকাই এঁকেছি? মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির গোপন কার্মকাণ্ডে কি আমি কোনো কাজ করিনি? মুক্তিযুদ্ধে কি আমার ভূমিকা ছিল না? স্বাধীনতার পরে কি গণতন্ত্র ও সাম্যের জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করিনি?

শিবুদার এ ক্ষোভ ছিল ন্যায়সংগত। ষাটের দশক থেকে ‘নিউক্লিয়াসের’ (বিপ্লবী পরিষদ) গোপন সদস্য হিসেবে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে স্বাধীনতার জন্য কাজ, মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধা ও সংগঠকের কাজ, স্বাধীনতার পরে জাসদের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে একে গড়ে তোলা, সামরিক-বেসামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জানবাজি লড়াই- সবই তো শিবুদা করেছেন। পতাকা অঙ্কন তো তার সে দীর্ঘ সংগ্রামেরই অংশ!

স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে যারা গড়ে তুলেছেন, পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই নানা কারণে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে পারছেন না। কিন্তু শিবুদা ছিলেন ব্যতিক্রম। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে তিনি বেশ প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব। শিবুদা সব বয়সি মানুষের কাছে ছিলেন বন্ধুর মতো। নেতাসুলভ কৃত্রিম ভাবগাম্ভীর্য তার মধ্যে ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি তার রাজনৈতিক অবদানকে বিক্রি করে লোভের পথে পা বাড়াননি। তাই তিনি একজন আদর্শবাদী ত্যাগী ব্যক্তিত্বের অনন্য উদাহরণ তৈরি করে গেছেন। বর্তমান প্রজন্ম শিবুদার জীবন থেকে উদ্বুদ্ধ হবে- এমনটাই আমার প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রছাত্রী সংসদ (ডাকসু) ১৯৮৯-৯০

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close