গাজী শাহনেওয়াজ

  ০৫ মে, ২০২৪

সমস্যার বেড়াজালে রেল

বহু সমস্যায় জর্জরিত বাংলাদেশ রেলওয়ে। টিকিট কালোবাজারি, দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুর্নীতি, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না মানা, প্রকল্পের কাজে গাফিলতি, দায়িত্বে অবহেলা, শিডিউল বিপর্যয় এবং সিগন্যালিং সমস্যা রেলের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রথম সভায় নানা অসন্তোষ ও ক্ষোভ ঝেড়েছেন কমিটির সভাপতিসহ কয়েকজন সদস্য; যারা একাদশ সংসদেও এ কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। তারা রেলের লাভজনক না হওয়ার পেছনে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিকে দায়ী করেছেন। ফলে বিএনপি-জামায়াতের সময়ে তলানিতে পৌঁছানো রেলকে টেনে তুলতে বর্তমান সরকারের নানামুখী উদ্যোগেও লাভজনক হচ্ছে না এই খাতটি।

সূত্র বলছে, গত বছরে এই মন্ত্রণালয়ে সরকারের রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। অথচ রেল থেকে আয় হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭০০ কোটি। ঘাটতি ১ হাজার ৮০০ কোটি।

রেল সংসদীয় কমিটি বলছে, রেলেও বহু সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা নিরসন করা সম্ভব হলে রেলকে লাভজনক করে বছরে আট হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রেনগুলো যথা নিয়মে পরিচালনা, ট্রেনের ইঞ্জিনে সিসি ক্যামেরা লাগানো এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম স্টেশনে স্ক্যানিং মেশিন বসানোর জন্য গত ১০ বছর আগে সিদ্ধান্ত হয়। দীর্ঘ সময় পেরিয়েছে অথচ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে রেল কর্তৃপক্ষের গড়িমসির অন্যতম কারণ অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ হওয়া। কারণ স্ক্যানিং মেশিন বা সিসি ক্যামেরা বসালে বিভিন্ন অবৈধ মালামাল যেমন- ফেনসিডিল, ইয়াবা, স্বর্ণ চোরাচালান নির্বিঘ্নে সম্ভব নয়। এতে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের উপরি আয় কমে যাবে। ফলে সংসদীয় কমিটি কিংবা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গড়িমসি করে কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী সভায় বলেন, প্রতিদিন রেলে হাজার হাজার যাত্রী ট্রেন ব্যবহার করছে। কিন্তু স্ক্যানিং মেশিন নেই। তিনি অতি দ্রুত ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে স্ক্যানিং মেশিন বসানোর তাগিদ দেন।

নাটোর-২ আসনের সরকার দলীয় এমপি ও রেল সংসদীয় কমিটির সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বলেন, গত সংসদীয় কমিটিতেও রেলের ব্যাপক অনিয়মের তথ্যাদি উপস্থাপন করেছিলাম। কিন্তু এর কোনো প্রতিকার বিগত পাঁচ বছরে দেখতে পাইনি। আমি কমিটির সদস্য হয়ে যখনই মন্ত্রণালয়ে গিয়েছি দেখতে পেয়েছি মন্ত্রীর সন্তান সেখানের বড় কনট্রাক্টর। তিনিই রেলের সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন; এসব অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। সভায় বর্তমান মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যেসব কর্মকর্তার কারণে রেলের কাজে গাফিলতি হয়েছে এবং সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে তাদের বহাল রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।

শফিকুল ইসলাম বলেন, রাজশাহীতে রেলের একজন ঠিকাদার আছে আশরাফ আলী বিশ্বাস, সে রেল ভবনকে জিম্মি করে রেখেছে তার কথায় যেন রেল মন্ত্রণালয়ে সবকিছু হয়, সবার সঙ্গে সম্পর্ক করে অবৈধ পন্থায় হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।

কমিটির অপর সদস্য ও রাজশাহী-২ আসনের এমপি মো. শফিকুর রহমান বলেন, আমার এলাকায় প্রায় ৪২ বছর আগে একটি আধুনিক রেল ভবন নির্মাণের কথা ছিল এবং কাজও শুরু হয়। পাইলিংয়ের জন্য যে টাকা খরচ হয় তা অপচয় হয়েছে। পাইলিং ও পরিকল্পনা করার পর জানতে পেরেছি দোতলার ওপর ভবন করা যাবে না। এভাবে এত টাকা অপচয়ের কোনো মানে হয় না।

ট্রেনের লোকসান ও টিকিট কালোবাজারি প্রসঙ্গ তুলে ধরে শফিকুর রহমান বলেন, রাজশাহীর ঠিকাদার আশরাফ আলী বিশ্বাস ও মোমিন নামে এক বুকিং ক্লার্ক এসব টিকিট কালোবাজারি করেন। বিগত বিএনপি সরকারের আমলে কিছু বাস মালিকদের সুবিধা দেওয়ার জন্য রেলওয়েকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। ঠিকাদারদের সুবিধা দেওয়ার জন্য রেলের আউটসোর্সিং কিছু জনবল নিয়োগ দেওয়া হয় অথচ তাদের কোনো কাজও নেই। আউটসোর্সিং শ্রমিকদের ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা করে ঠিকাদার বেতন দেয় আর পুরো টাকা ঠিকাদারের পকেটে যায়।

দুজন সদস্যের উত্থাপিত তথ্যের জবাবে রেলমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, আমার কোনো নিকটাত্মীয় বা ছেলেমেয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় বা অধীনস্থ কোনো সংস্থায় তদবির বা কোনো প্রভাব বিস্তার করবে না। তিনি টিকিট কালোবাজারি চক্রের হোতাদের ধরার জন্য তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এদিকে, গাজীপুরের জয়দেবপুর জংশনে রেল দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনযাত্রায় বড় ধরনের শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে বেশির ভাগ ট্রেন ছেড়েছে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা দেরিতে। এতে গরমে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। রেলসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্ঘটনা কারণে বিলম্বে ছাড়ছে ট্রেন, যা স্বাভাবিক হতে লাগবে আরো অন্তত এক দিন। কিশোরগঞ্জগামী এগারোসিন্ধু এক্সপ্রেস ছেড়েছে চার ঘণ্টা দেরিতে। লালমনিরহাটগামী বুড়িমারী এক্সপ্রেস ছাড়ে তিন ঘণ্টা দেরিতে। এতে প্রচণ্ড গরমে দুর্ভোগ বাড়ে যাত্রীদের।

এদিকে, ১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে আগে যে রেয়াত সুবিধা দেওয়া হতো তা তুলে নেওয়া হয়েছে, ফলে বাড়তি ভাড়া গোনা যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তারা বেশি দূরত্বের যাত্রীরা ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। তবে রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, রেলের ভাড়া আসলে বাড়েনি। বেশি দূরের যাত্রীদের ভাড়ায় রেয়াত সুবিধা দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার বলেন, আগে যে রেয়াত সুবিধা বিদ্যমান ছিল, ৪ মে থেকে রেয়াদ সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। অতীতের নিয়মানুযায়ী, এত দিন কোনো যাত্রী ১০১ থেকে ২৫০ কিলোমিটার ভ্রমণে গেলে তার ভাড়ার ক্ষেত্রে ২০, ২৫১ থেকে ৪০০ কিলোমিটার ভ্রমণে ২৫ এবং এর বেশি দূরত্বের জন্য ৩০ শতাংশ ছাড় পেতেন রেলের যাত্রীরা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close