নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

শ্রমজীবীদের কষ্টের মাত্রা ছাড়িয়েছে

* তিন দশকের মধ্যে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৪-৫ ডিগ্রি বেশি * তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত * ঘরের বাইরে শরীর ঝলসে যাওয়ার মতো যন্ত্রণাবোধ হয়, ঘাম ঝরে, তৃষ্ণা বাড়ে; সব মিলিয়ে ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেসব স্থানে গত সাত দিন ধরে তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে, গত ৩০ বছরের একই সময়ের গড় তাপমাত্রার তুলনায় তা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি বলে আবহাওয়া অফিসের তথ্য থেকে জানা গেছে। চলতি বর্ষাপূর্ব মৌসুমে দেশে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি হওয়ায় অনুভূত হচ্ছে আরো ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা। এ অবস্থায় প্রচণ্ড অস্বস্তি বিরাজ করছে জনজীবনে।

রাজধানীর রামপুরায় আবুল হোসেন নামে এক রিকশাচালক বলেন, খরতাপে শরীর ঝলসে যাওয়ার মতো যন্ত্রণা বোধ হয়, একইসঙ্গে ঘাম ঝরতে থাকে প্রচুর, তৃষ্ণা বাড়ে; সব মিলিয়ে ভীষণ অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। আমাদের মতো শ্রমজীবী মানুষ এবং যারা খোলা আকাশের নিচে রোদে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেন, তাদের কষ্ট মাত্রাছাড়া। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক বলেন, আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি থাকায় প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়েও ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রার গরম অনুভূত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একটি নির্দিষ্ট তারিখে একটি স্থানের গড় তাপমাত্রা ৩০ বছরের তাপমাত্রার গড় করে গণনা করা হয়। তাপপ্রবাহের কারণে আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া ৭২ ঘণ্টার ‘হিট অ্যালার্ট’র সময় শেষ হচ্ছে আজ সকালে। আবহাওয়াবিদরা বলেন, চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, এল নিনোর প্রভাবে এ তাপপ্রবাহ সৃষ্টি হয়েছে, যা বর্তমানে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে প্রভাব ফেলছে এবং এটি এ মাসের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির জুলি অ্যান রাইগলি গ্লোবাল ফিউচারস ল্যাবরেটরির সিনিয়র গ্লোবাল ফিউচার সায়েন্টিস্ট অধ্যাপক রাশেদ চৌধুরী বলেন, এল নিনো লা নিনার দিকে উল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং চলতি বছর সর্বোচ্চ উষ্ণতম হিসেবে রেকর্ড হতে পারে। রাশেদ চৌধুরী বলেন, এল নিনোর সময় মৌসুমি বায়ু দুর্বল হয়ে যায়, প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরিভাগের পানি উষ্ণ হয়ে ওঠে এবং পূবের বাতাস স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এল নিনোর প্রভাব শিগগিরই চলে যাবে এবং এর ফলে সাগর ও বাতাসের আচরণ বিপরীত হবে। প্রশান্ত মহাসাগরে এল নিনো এবং লা নিনার যে প্রভাব, তা বিশ্বব্যাপী আবহাওয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।

এদিকে রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফুটপাতই প্রায় ফাঁকা। কিছু কিছু ফল, হরেক রকম টুকিটাকি যন্ত্র ও গৃহস্থালিসামগ্রী ও পোশাকের পসরা বসেছে। বড় বড় ছাতার নিচে পসরা সাজিয়েছেন তারা। অনেকের আবার ছাতা নেই। কথা হলো ফল বিক্রেতা রুহুল আমিন, গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি বিক্রেতা বাবুল হোসেন, পোশাক বিক্রেতা আবু সুফিয়ানসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানান ঈদ, পহেলা বৈশাখের ছুটির প্রভাব এখনো আছে। সে কারণে তাদের বিক্রি কম। কিন্তু খররোদে পসরা নিয়ে বসে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। ছাতা থাকায় সরাসরি রোদের তাপ গায়ে লাগছে না। তবে এ এলাকার সড়কে কোনো গাছপালা না থাকায় আগুনের হলকার মতো রোদের তাপ এসে শরীরে লাগে। যারা ছাতা বসানোর মতো জায়গা পাননি, তাদের কষ্ট আরো বেশি।

ধানমন্ডির জিগাতলা এলাকায় রিকশাভ্যানে করে শাকবিক্রি করেন আবুল কাশেম। রায়েরবাজারের সাদেক খান পাইকারি কাঁচাবাজার থেকে শাকসবজি কিনে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে বিক্রি করা তার পেশা। তিনি জানান, বিভিন্ন ধরনের ১৫০ থেকে ২০০ আঁটি শাক প্রতিদিন বিক্রি করতেন। এখন ৭০ থেকে ৮০ আঁটি বিক্রি হচ্ছে। কারণ রোদে শাক নেতিয়ে যায়। ক্রেতারা কিনতে চান না। তা ছাড়া সারা দিন পথে পথে ঘোরাও সম্ভব হচ্ছে না। সরাসরি কায়িক শ্রম না করলেও প্রখর রোদে লম্বা সময় ধরে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয় শহরের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত পুলিশ ও আনসার সদস্যদের। শহরের বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যাল মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট ও পরিদর্শকের সঙ্গে কথা হলো।

শাহবাগের ট্রাফিক পুলিশ পরিদর্শক এ কে এম মনজুরুল আলম বলেন, ট্রাফিক পুলিশের ৮ ঘণ্টা করে টানা কাজ করতে হয়। কখনো কখনো আরো বেশি। তাপপ্রবাহের মধ্যেও এতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে তারা কর্তব্যরতদের পালা করে ১৫ থেকে ২০ মিনিট করে বিশ্রাম দেন। যেখানে চারজন পুলিশ ও দুজন সার্জেন্ট থাকেন, সেখানে দুজন পুলিশ ও একজন সার্জেন্ট হয়তো ১৫ মিনিট সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করেন, অন্যরা পুলিশ বক্সে বা কোনো গাছ থাকলে তার ছায়ায় দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নেন। তাছাড়া ছাতা ব্যবহার করা হচ্ছে। ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত পানি, গ্লুকোজ, খাওয়ার স্যালাইন সরবরাহ করা হয়েছে। পুলিশ কেউ অসুস্থ হননি, কিন্তু শাহবাগ মোড়ে প্রায় প্রতিদিনই দুয়েকজন রিকশাচালক, বাসের যাত্রী বা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসব অসুস্থ লোককেও কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা সহায়তা দিচ্ছেন। এখানে (শাহবাগে) সবার জন্য বিশুদ্ধ খাওয়ার পানিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেন, তাপপ্রবাহ তীব্র হলেও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে শিথিলতার সুযোগ নেই। তবে কর্তব্যরত পুলিশের শরীর-স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক নিজ উদ্যোগে এগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছেন। তাছাড়া কেউ অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্স রাখা ও হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে সর্বসাধারণের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close