রেজাউল করিম

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

মতামত

টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গৌরব

টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প বাংলাদেশের অন্যতম পুরোনো কুটিরশিল্প। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এই ঐতিহ্যবাহী শাড়ি টাঙ্গাইল জেলায় তৈরি হয় এবং এই জেলার নামেই এর নামকরণ করা হয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি। টাঙ্গাইলে উৎপাদিত শাড়ি পাবনা শাড়ি বা সিরাজগঞ্জ শাড়ি হতে পারে না। তদ্রুপ টাঙ্গাইল শাড়ি বিদেশি বা ভিনদেশি কোনো প্রদেশের নামেও পরিচিতি পেতে পারে না। কিন্তু হঠাৎ টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লীতে খবর ছড়িয়ে পড়ল টাঙ্গাইল শাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর বিতর্ক ও সমালোচনা হয়েছে। ভারতের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তে উৎফুল্ল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারের পোস্টে এ শাড়ির কারিগরদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি দাবি করেন, টাঙ্গাইল শাড়ি নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের পণ্য। এই সংবাদের পর তাঁতপল্লীসহ পুরো বাংলাদেশ হতভম্ব হয়ে পড়ে। নড়ে বসে সরকারও। যেখানে টাঙ্গাইল শাড়ির সঙ্গে বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের নাম জড়িয়ে আছে। সেই টাঙ্গাইল শাড়ি ভারত দাবি করে কীভাবে? পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত শাড়ি পশ্চিমবঙ্গের শাড়ি হতে পারে। টাঙ্গাইল শাড়ি বহু বছর ধরে আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু তার পরও টাঙ্গাইল শাড়িকে ভারতের পণ্য হিসেবে দাবি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। সরকারের পক্ষ থেকে টাঙ্গাইল তথা বাংলাদেশীয় (জিআই) পণ্য হিসেবে পুনরায় আবেদন করে। গণমাধ্যম বলছে, টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলের নামেই পুনরায় জিআই স্বীকৃতি পাচ্ছে। দ্রুত গ্যাজেট হওয়ার সম্ভাবনার কথাও গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে।

কয়েক বছর আগেও দেখতাম আমাদের দেশের নারীদের প্রধান পোশাক ছিল শাড়ি। আমাদের নারীরা শাড়ির বাইরে অন্য কোনো পোশাক খুব একটা পছন্দ করতেন না। শাড়িতেই বাঙালি নারীদের প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পেত। শাড়িময় বাঙালি নারীর জগৎ দখল করে রেখেছিল ঢাকাইয়া জামদানি, শীর্ষে ছিল টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকেও জানতাম টাঙ্গাইলের শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গৌরব। কিন্তু গত ২ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তশিল্প বিভাগ জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছিল। সেখানে টাঙ্গাইল শাড়িকে নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের পণ্য হিসেবে ধরা হয়। ১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ভারত সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উৎপন্ন, এটি একটি ঐতিহ্যগতভাবে হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর সূক্ষ্ম গঠনবিন্যাস, প্রাণবন্ত রং এবং জামদানি কাজের জন্য বিখ্যাত, এটি এই অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।

বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ টাঙ্গাইল। টাঙ্গাইল নামটি পরিচিতি লাভ করে ১৫ নভেম্বর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে মহকুমা সদর দপ্তর আটিয়া থেকে টাঙ্গাইলে স্থানান্তরের সময় থেকে। ইংরেজ আমলে এ দেশের লোকরা উঁচু শব্দের পরিবর্তে ‘টান’ শব্দই ব্যবহার করতেন। এখনো টাঙ্গাইল অঞ্চলে টান শব্দের প্রচলন আছে। এই টানের সঙ্গে আইল শব্দটি যুক্ত হয়ে টান আইল হয়েছিল। আর সেই টান আইলটি রূপান্তরিত হয়েছে টাঙ্গাইলে। টাঙ্গাইলের নামকরণে নানা মত রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে মোগল প্রশাসন কেন্দ্র যখন আটিয়াতে স্থাপন করা হয় তখন এই অঞ্চলটি জমজমাট হয়ে ওঠে। ওই সময় ঘোড়ার গাড়ি ছিল যাতায়াতের একমাত্র বাহন, যাকে বর্তমান টাঙ্গাইলের স্থানীয় লোকরা বলত টাঙ্গা। এ অঞ্চলের টাঙ্গা গাড়ির চলাচল ছিল স্থলপথে সর্বত্র। আল শব্দটির কথা এ প্রসঙ্গে চলে আসে। বর্তমান টাঙ্গাইল অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের নামের সঙ্গে এই আল শব্দটির যোগ রয়েছে। আল শব্দটির অর্থ সীমা টাঙ্গা+আইল এভাবে যোগ করে হয়েছে টাঙ্গাইল। মূলত কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

কোনো পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলে বিশ্বব্যাপী এর ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়। এ ক্ষেত্রে টাঙ্গাইলে উৎপাদিত পণ্য ভারতের ব্র্যান্ডিং পণ্য হয় কীভাবে? ভারতীয় দাবির উত্তরে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, দুশ বছরের ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল তাঁতশিল্প ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ব্যাপক প্রসারিত হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তাদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়। তারা দেলদুয়ার ও সন্তোষ এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইল আসে। পরে টাঙ্গাইলে বসবাস শুরু করে। শুরুতে তারা নকশাবিহীন কাপড় তৈরি করতেন। ১৯০৬ সালে মহাত্মা গান্ধী স্বদেশি আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের তৈরি কাপড় বর্জন করা। এ সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) তাঁতশিল্পের প্রসার লাভ করে। ১৯২৩-২৪ সালে তাঁতের কাপড়ে নকশা প্রবর্তন করা হয়। ১৯৩১-৩২ সালে শাড়ি তৈরির জন্য জাকুয়ার্ড তাঁত প্রবর্তন করা হয়। টাঙ্গাইলের তাঁতগুলো তাঁতিদের বাড়ির অভ্যন্তরে বসানো হয়। ৭২ শতাংশ কুটিরশিল্প পাঁচটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত, ১১ শতাংশ তাঁত ৬ থেকে দশটি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং ৬ শতাংশ তাঁত ১১ থেকে ১২টি তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত এবং অবশিষ্ট ১১ শতাংশ কুটিরশিল্প বারোর অধিক তাঁতের সমন্বয়ে গঠিত। বারোর অধিক তাঁত-সংবলিত কুটিরশিল্পগুলো ছোট কারখানা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

তথ্য পাওয়া যায়, ১৯৯২ সালে টাঙ্গাইল জেলায় ১ লাখের অধিক তাঁত ছিল। ২০০৮ সালে ১০০০০০টি ছোট ও বড় কারখানায় ৩৭২২২টি তাঁত ছিল এবং ৭০০০০ তাঁতি টাঙ্গাইল জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেসিক সেন্টারের অধীনে কাজ করতেন। ২০১৩ সালের একটি শুমারিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, টাঙ্গাইল জেলায় ওই সময় ৬০০০০ তাঁত ছিল। এর মধ্যে ৮৩০৫টি পিট তাঁত, ৫১১৪১টি চিত্তরঞ্জন তাঁত এবং ৮৯২টি পাওয়ার তাঁত। এ তাঁতশিল্পের একক বৈশিষ্ট্যের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। টাঙ্গাইল শাড়ির তাঁতিরা বিশেষ দক্ষতার মাধ্যম টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি করে। জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নের বসাক সম্প্রদায় সব থেকে পুরোনো সম্প্রদায় যারা আদি ঐতিহ্য ধরে রেখে তাঁতের শাড়ি তৈরি করে। প্রাপ্ত তথ্যে বর্তমানে ৩২৫০০০ জন তাঁতি, মালিক ও ব্যবসায়ী-ক্রেতা এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। টাঙ্গাইলে মূলত সুতি শাড়ি, আধা-রেশমি শাড়ি (হাফ সিল্ক শাড়ি), সফট সিল্ক শাড়ি, সুতি জামদানি শাড়ি, গ্যাস-মারচেন্ডাইজড শাড়ি, টুইস্টেড-সুতি শাড়ি, ডাংগো শাড়ি ও বালুচুরি শাড়ি তৈরি হয়। টাঙ্গাইল শাড়ি কোনোভাবেই ভারতের হতে পারে না। এটা ঠিক, এই শাড়ি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত বসাক সম্প্রদায়ের একটি অংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গেছেন। তাই বলে তাদের শাড়ি তো টাঙ্গাইল শাড়ি হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত শাড়ি কীভাবে টাঙ্গাইলের শাড়ি হয়?

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর (ডিপিডিটি) দেশে কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতি দেয়। কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির জন্য কোনো সংগঠন বা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আবেদন করতে হয়। সেখানে ওই পণ্যের ইতিহাস, জিআই স্বীকৃতির পক্ষে যুক্তি, এর ভিন্নতা সম্পর্কিত তথ্য দিতে হয়। এসব নিয়ে বিশ্লেষণের পরই পণ্যটি স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন পাস হয় ২০১৩ সালে। প্রথম জিআই পণ্য হয় জামদানি। এরপর গত ১০ বছরে মাত্র ১১টি পণ্যের জিআই স্বীকৃতি হয়েছে। আর ২০২৩ সালে এক বছরেই ১০টি পণ্যের স্বীকৃতি মিলেছে। ই-কমার্স ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (ইডিসি) নামের বেসরকারি একটি সংগঠনের সদস্যদের স্বেচ্ছাশ্রমে এক বছরে এতগুলো পণ্যের স্বীকৃতির কাজটি হয়েছে। ভারতের জিআই জার্নালে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়। আর স্বীকৃতি পায় গত ২ জানুয়ারি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেশীয় পণ্য টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি এত দিন। ঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে হয়তো এমন সমালোচিত ঘটনা ঘটত না। ৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য করার বিষয়ে ই-মেইলে সব নথিসহ আবেদন করেন।

আমাদের দেশের আনাচে-কানাচে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যার সঙ্গে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য সরাসরি যুক্ত। প্রাচীন ‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ টাঙ্গাইল জেলারই একটি ঐতিহ্য। আর এই শাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি হাতে বোনা হয়। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি অংশ ভারতে গিয়ে ‘টাঙ্গাইল শাড়ির’ তৈরি করেন। কিন্তু ভারতের সীমানায়, তাদের ভৌগোলিক সীমারেখায় বুনন করা শাড়ি কেমন করে টাঙ্গাইল শাড়ি হয়? এ ক্ষেত্রে বলা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলো ব্রিটিশরা দাবি করতে পারে। যেহেতু তারা দুইশ বছর এই উপমহাদেশ শাসন করেছিল। অতএব আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। বন্ধ করতে হবে এসব অযাচিত পদক্ষেপ। টাঙ্গাইল শাড়ি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গৌরব। এটিই ধ্রুব সত্য।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close