মিথিলা ফারজানা

  ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ওয়ান এক্স বেটের কবলে যুবসমাজ

বাজির খেলায় ঝুঁকে যাচ্ছে যুবসমাজ। দেখা দিচ্ছে তাদের আর্থিক সংকট। এই বাজি খেলার অন্যতম মাধ্যম ‘ওয়ান এক্স বেট’, যা আজ তরুণসমাজে অতি পরিচিত একটি অ্যাপ্লিকেশন। সোজাসাপ্টা বাংলায় বলা যায় ‘অনলাইন জুয়া’। এই অনলাইন জুয়া আমাদের তরুণসমাজ কে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে? সম্প্রতি আমার দেখা কিছু তরুণ পরিবারের থেকে টাকা নিচ্ছে, না দিলে চুরি করে নিচ্ছে শুধু এই অ্যাপে খরচ করতে। বাজি ধরবে, জিতলে টাকা পাবে না জিতলে টাকা গচ্ছা দেবে।

আজকাল আর গলির মোড়ে তরুণ কিংবা যুবকরা আড্ডা দিচ্ছে না। লাইব্রেরিগুলোতে দিন দিন পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গ্রুপ স্টাডি হচ্ছে না। নতুন কিছু করার চিন্তার হার কমে যাচ্ছে। কিশোর-তরুণরা দলবদ্ধভাবে এখন ওয়ান এক্স বেটে টাকা বাজি ধরছে। তিক্ত সত্য, টাকা ছাড়া জীবন মূল্যহীন। অথচ এই টাকাই সব অনর্থের মূল। যার জীবন্ত প্রমাণ ওয়ান এক্স বেট এবং এর প্রভাব গোটা জেনারেশনের জন্য হুমকিস্বরূপ। ধারণা নেওয়া যাক, এই ওয়ান এক্স বেট কী, কীভাবে কাজ করে, আর এর টাকা প্রদানের মাধ্যমই বা কী।

এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ওয়ান এক্স বেট সম্প্রতিই কাজ করা শুরু করেছে। তবে ওয়ান এক্স বেট প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৭ সালের দিকে। ওয়ান এক্স বেট নিয়ে রিসার্চে উঠে এসেছে, তারা বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের কাছে খালি হাতে আসেনি। বিশাল আকারের প্রমাণ নিয়ে এসেছে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে। প্রলোভন দেখানোর সব বিষয় তারা ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা করে ফেলেছে। যেমন : বিভিন্ন ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল টুর্নামেন্ট মোট কথা স্পোর্টস ইত্যাদির ইভেন্টের প্রি-ম্যাচ বেটিং এবং রিয়েল-টাইম উভয় ক্ষেত্রেই ক্রিকেট অনুরাগীদের অ্যাক্সেস রয়েছে এবং একই সঙ্গে রয়েছে পেমেন্টের ভিন্নতা। দেখা যায় প্রি-ম্যাচ বেটিং এবং রিয়েল-টাইম উভয়ের পেমেন্ট অ্যামাউন্ট আলাদা এবং এই ভিন্ন দুই ক্ষেত্রে টাকা ইনভেস্ট করার পরিমাণও আলাদা। এখানে একশ টাকা বাজি ধরেও খেলা যায় আবার হাজার হাজার টাকা বাজি ধরেও খেলা যায়।

মানুষের বেশির ভাগ ঝোঁক রয়েছে অনলাইন ক্যাসিনোর প্রতি। আর এখানেই মূলত চাল খাটানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ এক টাকা দিয়ে চার টাকা পাবে এমন আশা ওয়ান এক্স বেট প্রতিষ্ঠা করেছে। আর এ ক্ষেত্রে ক্যাসিনো হলো ওয়ান এক্স বেট ওয়েবসাইটের সবচেয়ে পুরোনো বিভাগ। যেখানে সব আকর্ষণীয় গেম রয়েছে। একজন ওয়ান এক্স গেমার সম্ভাব্য, যা ভাবতে পারে তার সবকিছুই এতে রয়েছে। যেমন ক্ল্যাসিক স্লট মেশিন, থ্রিডি স্লট, ব্যাকার্যাট, রুলেট, ব্ল্যাকজ্যাক, পোকার, হুইল অব ফরচুন, জ্যাকপট, কেন, বিঙ্গো, ড্রপস অ্যান্ড উইনস, একচেটিয়া গেম। তথ্যানুযায়ী, ওয়ান এক্স বেট শুধু মাইক্রোগেমিং, ভিভোগেমিং, নেটএন্ট, প্লেটেক, প্রাগমাটিক প্লে, অ্যারিস্টোক্র্যাট, নভোম্যাটিক, আইগ্রোসফট, এজুগি, প্লে এন গো, আইজিটির মতো বিশ্বস্ত গেম প্রদানকারীদের সঙ্গে কাজ করে থাকে।

ওয়ান এক্স বেট বাংলাদেশি টাকাসহ বিভিন্ন মুদ্রায় অর্থ প্রদান গ্রহণ করে। আমানতের জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রনিক কার্ড, সপরিষেবা টার্মিনাল, ক্রেডিট এবং ডেবিট কার্ড, ক্রিপ্টোকারেন্সি, অনলাইন ব্যাংকিং এবং ইলেকট্রনিক ভাউচার। এসব উপায়ের মাধ্যমেই সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে টাকা ঢালছেন। সাধারণত জুয়ায় যা হয়, প্রথম দিকে লাভ হলেও আস্তে আস্তে অর্থ গচ্ছা যায়, যা জুয়ারু নিজেই সঠিকভাবে অনুমান করতে পারে না। তার মস্তিষ্ক তাকে ইঙ্গিত দেয়, আবার চেষ্টা করো, এবার অনেক লাভ হবে। এখন পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গিয়েছে ওয়ান এক্স বেট টাকা জমা ও তোলার ৫০টিরও বেশি উপায় অফার করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে রকেট, বিকাশ, ফোনপে, গুগল পে, ক্যাশ অন ডেলিভারি, উপায় ওয়ালেট, মাচ বেটার, অ্যাস্ট্রোপে নেটওয়াচ, ভিম, ইম্পিস, ভিসা, মাস্টারকার্ড ইত্যাদি সব উপায়।

মূল বিষয় দাঁড়াচ্ছে, ওয়ান এক্স বেট হচ্ছে একটি মাইন্ড গেম কিংবা যাকে বলা হয় মস্তিষ্ক চালিত খেলা। যার নিয়ন্ত্রণ মস্তিষ্ক করে থাকে। আমাদের হিউম্যান সাইকোলজি মতে, মানুষ সেসব বিষয়েই বেশি আকৃষ্ট হয় যেখানে সে একবার লাভ পেয়েছে, মজা পেয়েছে।

ওয়ান এক্স বেটের কবলে পরে অনেক অনেক যুবক নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে, যা একবিংশ শতাব্দীর জন্য বিরাট একটি দুঃসংবাদ। যে বয়সে তারা বইয়ে মুখ গুঁজে থাকবে কিংবা খেলার মাঠে খেলবে সে বয়সে তারা জুয়ায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত আমরা দেখতাম গ্রামের দিকের ছেলেরা ছুটির দিনগুলোতে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করছে কিংবা ফুটবল। আবার দেখা যেত ছোটখাটো বনভোজন, গানের আড্ডা, দলবদ্ধ হয়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরায় মত্ত। ছুটি-পরবর্তী সময়ের পরিকল্পনা করছে। অথচ আজ তারা আলোচনা করছে কীভাবে কী করলে অনলাইন জুয়া থেকে বেশি আয় করা যাবে। এর ভয়াবহতা নিশ্চয়ই আমরা আঁচ করতে পারছি। কতটা বিপর্যয়ের মুখে আমাদের তরুণসমাজ আমরা কি ভেবে দেখেছি কিংবা এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি?

শুধু যে যুবসমাজে এর প্রভাব পড়েছে তাও নয়। প্রায় সব বয়সের বেশির ভাগ লোকই এখন এই অনলাইন জুয়া আসক্ত। লাভের আশায় কেউ গবাদি পশু বিক্রি করছেন, কেউ বা নিজের সম্বল দোকান বিক্রি করছেন কেউবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছে এই অ্যাপ নিয়ে। এর প্রভাব পড়ছে সমগ্র পরিবারের ওপর এবং আমাদের সমাজের ওপর। একজনের থেকে তথ্য পেয়ে অন্যজন আসক্ত হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে হয়তো এই অ্যাপের প্রভাব ছড়িয়ে যাবে সমগ্র জেনারেশনে।

অনলাইনের যুগ, মানুষ চাইলে এখন কি না করতে পারে? হাজার হাজার প্ল্যাটফরম রয়েছে, যেখান থেকে আয় করা সম্ভব হলেও ওয়ান এক্স বেটে আসক্ত হচ্ছে তরুণ, যুবক ও মধ্যবয়সি পুরুষরা। তাদের মধ্যে কর্মবিমুখতার লক্ষণ। কাজে মন বসে না, মাথায় ঘোরে ওয়ান এক্স বেটে বাজি ধরার চিন্তা। যেন সমগ্র মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করছে অনলাইন জুয়াখ্যাত ওয়ান এক্স বেটের

আসক্তি।

কোথায় তাদের সেই সোনালি দিন? আমাদের সোনালি সময়টা আজ বদ্ধ হচ্ছে ওয়ান এক্স বেটের কবলে। ওয়ান এক্স বেটের জন্য তারা যে মূল্যবান সময় অপচয় করে যাচ্ছে সেই সময়টা স্কিল ডেভেলপমেন্ট বা জ্ঞানার্জনের কাজে ব্যয় করার কথা। কিন্তু হচ্ছে কী? নেশাদ্রব্য যেমন মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত করে দেয়, ঠিক তেমনি ওয়ান এক্স বেটও মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত করে দিচ্ছে। লাভের আশায় মানসিক, আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। আমরা এখনো এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে না পারলেও ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পারব। তবে তখন কি অনেক দেরি হয়ে যাবে? আপনার সন্তান টাকার জন্য আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে, আপনার ছোট ভাই-বোন আপনার দিকে তেড়ে আসছে টাকার জন্য। অবাক

হওয়ার কিছু নেই, কারণ বাজি ধরা ব্যক্তির মস্তিষ্কে লাভের আশা ঘোরে। ফলে তিনি কী করছেন না করছেন সেসব বিষয়ে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য।

নেশাদ্রব্যে আসক্ত মানুষ চাইলে খুনের মতো অপরাধ করতে পারে। ওয়ান এক্স বেটের প্রভাবেও ঠিক একই ঘটনা ঘটতে পারে। সম্ভাব্য অনেক ক্ষতিই হতে পারে এবং হচ্ছে। আমরা আমাদের পরিবারকে পর্যাপ্ত সময় দিই। আমাদের খোঁজ রাখা উচিত ছোট ভাই-বোন কী করছে, অনলাইনে সে কতটা সময় ব্যয় করছে এবং কোন ক্ষেত্রে সে সময় ব্যয় হচ্ছে। কেননা, ওয়ান এক্স বেট কমিউনিটি ছোট নয়। আমাদেরই উচিত পরিবারের সদস্যের খোঁজ নেওয়া, সাবধান করা। একটা কথা মনে পড়ে, একটা ভুল সারা জীবনের কান্না। ওয়ান এক্স বেটের কবল থেকে কাছের জনদের মুক্ত রাখতে ও তাদের ভুল শুধরে দিতে আমরাই পারি সার্বিক সাহায্য করতে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাদের এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, জমজম ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যাটস, বরিশাল

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close