কাউসার আহমেদ

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

মুক্তমত

মানবাধিকার পরিস্থিতি ও জনগণের প্রত্যাশা

মানবাধিকার হলো একজন মানব পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, আইন, অবাধ চলাফেরা, বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার ইত্যাদি) দরকার, সেসব সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে লাভ করার যে অধিকার সেটাই হলো মানবাধিকার।

মানবাধিকারের ধারণাটি প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত হলেও তা লিখিত আকারে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে। এর আগে ইসলাম ধর্মের মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.), খ্রিস্টান ধর্মগুরু যিশুখ্রিস্ট ও বৌদ্ধ ধর্মগুরু গৌতমবুদ্ধ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। তারা সব মানবসমাজকে তা পালনের জন্য উপদেশ দিয়ে গেছেন। আধুনিক যুগেও এর ব্যতিক্রম নয়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আমৃত্যু কাজ করেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, মাদার তেরেসাসহ অনেকে।

ইতিহাস অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, ১৯১৪ সালে পৃথিবীর ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রগুলো অক্ষয় ও মিত্র শক্তিতে ভাগ হয়ে যুদ্ধ শুরু করে। ফলে পৃথিবীতে খরা, খাদ্য অভাব, নৈতিকতার অবক্ষয় ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বিশ্বের নেতারা এমন একটা নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়। যার মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য তার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে পাশাপাশি পৃথিবী থেকে নাশকতা, যুদ্ধের অবসান ঘটবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘দি হিউম্যান ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস’ নামের ৩০ ধারার নীতি প্রণয়ন করা হয়। প্রথমে ৫৮টি দেশ সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অঙ্গীকার করে পরবর্তী ১৯৩টি দেশ এর সঙ্গে একমত পোষণ করে তা বাস্তবায়নের শপথ গ্রহণ করে।

পৃথিবীর সর্বত্র মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিবারণ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি। বিশ্বের একটা বড় জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের প্রকল্পের আওতায় আনতে পারেনি। মানবাধিকার বাস্তবায়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো দরিদ্রতা। যে দেশে বেঁচে থাকার জন্য খাবার জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে, সে দেশ কীভাবে সর্বজনীন আইন পালন করবে। এ ক্ষেত্রে দারিদ্র্য নিরসনের কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।

সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক কনভেনশন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক কনভেনশন, শিশু অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং নারীর প্রতি সব ধরনরে বৈষম্য দূরীকরণের আন্তর্জাতিক কনভেনশন হয়েছে। যেসব কনভেনশনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দলিল ও ঘোষণাপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। সেই অনুযায়ী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বাংলাদেশে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, আর্টিকেল নাইন্টিন, ব্লাস্ট, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্র্যাক, আশাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেন্ডার, বসবাসের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, জেন্ডার সমতা, বসবাস ও আইন পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এ ছাড়া ২০০৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করে। দারিদ্র্যমুক্ত করতে সরকারের পরিকল্পনায় গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা, শক্তি ফাউন্ডেশন গ্রামীণ মানুষদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিচ্ছি। নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকারে বিনামূল্যে ব্রাক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকার দেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ২৬ থেকে ৪৭ নং অনুচ্ছেদ প্রণয়ন করেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য এনজিওগুলো নারীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে। চাকরির ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে রাখা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরিক্ষায় নারীদের জন্য ৬০ শতাংশ আসন বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে বিশ্বের ১১০টি দেশ ৩০১টি পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শগুলো পর্যালোচনা করে অগ্রগতি প্রতিবেদন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার পরিষদের ৫৫তম অধিবেশনে তুলে ধরা হবে। ওই সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলোপ ও ফাঁসির দণ্ড কমিয়ে কারাদণ্ড প্রদান, সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত, সভা ও সংগঠনের অধিকার নিশ্চিতের ব্যবস্থা, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান, নাগরিক সমাজ বা এনজিও সদস্যদের হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন বন্ধ, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ এবং বাল্যবিয়ে বন্ধে আইন সংশোধন।

সুপারিশের মধ্যে আরো আছে- ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করা, বৈষম্যবিরোধী আইনপ্রণয়ন, ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ঘোষণা এবং শ্রমিকদের আইএলও স্বীকৃতসহ সব অধিকার নিশ্চিত করা ইত্যাদি। ওইসব সুপারিশ বাস্তবায়নসহ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ওইসব উদ্যোগের যথাযথ বাস্তবায়নই নতুন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close